একটি গল্প বলি।
একজন ভদ্রলোক তার প্রার্থনা করার সময় একটি বিড়ালকে বেঁধে রাখতেন, প্রার্থনা শেষে বিড়ালটি আবার ছেড়ে দিতেন। তাদের সন্তানেরা এই দৃশ্য দেখত।
অনেকদিন পর তার সন্তানদের একটি আনুষ্ঠানিক প্রার্থনার প্রয়োজন হয়। তারা বেঁধে রাখার জন্যে বিড়াল খুঁজতে থাকে। কিন্তু বিড়াল খুঁজে পায় না। খুঁজে পেলেও অনেক চেষ্টা করেও বিড়ালকে বাঁধতে পারে না। তাই অনেক শ্রম, সময় ব্যয় করেও বিড়াল বাঁধতে না পারার কারণে তারা প্রার্থনার আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে পারল না।
এখন বলি কেন এই গল্প বললাম (যদিও এটি কোনো গল্পই হয়নি)। তার সন্তানেরা শুধু উপরিতল থেকে তাদের বাবার কর্মকাণ্ড দেখেছেন। কিন্তু বিড়ালকে কেন বেঁধে রাখা হল তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি আর প্রার্থনাকে তারা বিবেচনা করেছে একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে। তাদের বাবা প্রার্থনার সময় বিড়ালকে বেঁধে রাখতেন যেন বিড়াল কোনোভাবে তার প্রার্থনার সময় বিরক্ত না করে। কিন্তু এই কারণটি তাদের সন্তানদের মাঝে সঞ্চারিত হয় নি।
আমাদের জীবনে, চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গিতেও এমনি রকম উপরিতল থেকে দেখে সিদ্ধান্ত, অনর্থক তর্ক, শ্রম, সময় মেধার অপচয়ের উদাহরণ খুঁজে দেখলেই পাওয়া যাবে। বিনা প্রশ্নে, বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ না করে, কোনো কিছুকে গভীর ও ভিন্ন দৃষ্টিতে না দেখে অনেক সময়ই বিভ্রান্তিমূলকভাবে নিজেদের মন, মেজাজ, মেধাকে নষ্ট করি।
আবার, উল্টোটাও হয়। সব কিছুকে গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে দেখতে তলানির খোঁজে নিজেদের তলিয়ে ফেলি।
এই জন্যে ‘জীবন এত ছোট কেনে’-র মাঝে নিজেদের মনন ও মেধাকে শাণিত করতে এই পাঠের মাঝে একটি ভারসাম্যমূলক পন্থা থাকা খুবই আবশ্যক-এই কথাটি আমি সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের চিন্তার ইতিহাসের পাঠচক্রে বছরের পর বছর যুক্ত থেকে দৃঢ়ভাবে বুঝতে পেরেছি। বিকাশ কেন্দ্রে চিন্তার ইতিহাসের পাঠচক্র এবং পাঠচক্রকে ঘিরে যে বন্ধুগোষ্ঠি পেয়েছি-এই পাওয়া আমার জীবনকে প্রতি মুহূর্তে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করছে-এটি আমি নিজের গভীর উপলব্ধি থেকে বলছি।
যখনই এই পাঠচক্রে বসি, সত্যি করে প্রতিবারই নতুন কিছু না কিছু কুড়িয়ে পাই। আর, বিকাশ কেন্দ্রের ক্যাফেটেরিয়ার আড্ডা, এই আড্ডাটি আমাকে প্রাণ খুলে শ্বাস নেয়ার আনন্দ অনেক অনেক বাড়িয়ে দেয়। এ এক মেধা ও মননের আকর্ষণ, খুবই তীব্র এর টান।
আর শেষে বলি, লিয়াকত ভাইয়ের চিন্তার ইতিহাসের পাঠচক্রই আমাকে ভাবনার ভেলায় ভাসতে শিখিয়েছে, কিশোর উপযোগি সহজ ও সার উপস্থাপন হচ্ছে আমার বই ‘ভাবনার ভেলায়’।
লেখক তালিকা
জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক
এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে।
রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’।
ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →