একটা ব্যাপারে আমি খুবই নিশ্চিত যে, সাম্যবাদ বা পুঁজিবাদ-কোথাও মানুষের অস্তিত্বের সমাধান মিলবে না। পুঁজিবাদ আমেরিকায় অনুসরণ করা হয়, কিন্তু দেশের অন্তর্জগতটি অত খারাপ নয়, অন্তত আমার চোখে, কিন্তু কিউবা ও ভিয়েতনাম ভ্রমণ করে আমি বুঝতে পেরেছি, আমেরিকার খারাপ দিকগুলোর জন্য ওদের ভুগতে হচ্ছে, এটা তো সাম্রাজ্যবাদেরই মতো। আমেরিকার লোকেদের হাতে টাকা আছে, তাদের গাড়ি আছে; আর অন্য সব লোককে মার্কিন বিদেশনীতির জন্য অনাহারে থাকতে হচ্ছে, বোমা খেতে হচ্ছে, রাস্তায় রক্তাক্ত হচ্ছে-এসব আমেরিকাতেও মারাত্মক ব্যাপার বলে পরিগণিত হবে। এ্যালেন গিন্সবার্গ, সাক্ষাৎকার, চারবাক
আমাদের লেখক স¤প্রদায় রাগ করিয়া বলিবেন, ‘কেন, আমাদের ভাষা কি সকল কাজের উপযোগি নয়? দেখ আমরা বাঙ্গলা ভাষায় কি না করিতেছি? কবিতা, উপন্যাস, সমাজনৈতিক, রাজনৈতিক ও দার্শনিক সকল প্রকার প্রবন্ধ ভূরি ভূরি লিখিতেছি; এমন কি জ্ঞেয় অজ্ঞেয়, সাধ্য অসাধ্য কোন বিষয়েই প্রবন্ধ ও গ্রন্থ লিখিতে কিছু মাত্র ইতস্ততঃ করিতেছি না, দুঃখের মধ্যে এই যে কেহ পড়ে না।’
ভাষা-বিভ্রাট, ভাষা-ভাবনা উনিশ-বিশ শতক, দীপঙ্কর ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৭
গেরাসিম লেবেদেফ রুশ পরিভ্রাজক স্বদেশ পরিজন পরিত্যক্ত ছোট্ট নগরি কোলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন থিয়েটার, বিদেশে অর্থচিন্তা বাদ দিয়ে লাভালাভ জলাঞ্জলি দিয়ে চতুর ইংরেজ কোম্পানির শত প্রলোভন ভুলে অথবা আমলে না নিয়ে মেতে উঠলেন অন্য এক নেশায়, পরিণামে তাঁকে সহ্য করতে হল ম্যালা দুর্ভোগ, ঋণ-অপবাদের বোঝা কাঁধে নিয়ে ত্যাগ করতে হল ভারতভূমি, নির্মম পরিহাস ইতিহাসের সোনালি হরফে গাঁথা হয়ে রইল লেবেদেফ নামের একজন পরিভ্রাজক, চতুর ইংরেজরা হারিয়ে গেল কালের গহ্বরে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সময়ের চিহ্নায়নে এভাবেই কি কেউ কেউ উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে রয়, দাগ কাটে ভবিষ্যতের ভাড়ারে, উপচে পড়া গোলাঘর এভাবেই কালকে ধারণ করে হয়তোবা। গেরাসিম কল্পনাও করতে পারবেন না তার এই প্রাচুর্য্যতা, ফসলের মুগ্ধতা।
উর্দু অথবা আরবি হরফে বাংলা লেখাবার জোর প্রচেষ্টা বেশি দিন আগের নয়, বুকের তাজা রক্তে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সে চেষ্টা পরিত্যক্ত-পরিত্যাজ্য হয়। কালের নিয়তি বহুজাতিক আগ্রাসন-বিপণনে আজ আমরা অজান্তেই ইংরেজি হরফে বাংলা লিখছি কোন প্রতিরোধ বা প্রতিবাদের কথা চিন্তা না করেই, বিপণন মধু অথবা কড়া আরক রসে ক্রমশ ধুঁকছি, বুদ হয়ে যাচ্ছি।
উষ্ণতাকে ব্যক্তি পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্ব দেই আমি, দেশ-কাল রাষ্ট্রিক পর্যায়েও। গড়পড়তা সাধারণ মানুষ নয়, যখন কারো সম্পর্কে বলতে চাই বলি-বোঝাই, তখন আলাদা কতগুলো বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত-চিহ্নায়িত করে তাকে আর দশজনের চাইতে স্বতন্ত্র করে তুলি। চিহ্নায়নের গোলক ধাঁধা এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে যে নিজে চিহ্নিত হবার বাসনা জাগে, নিজেকে জানান দিতে, অস্তিত্বের স্বরূপ প্রকটিত করতেও; আড়ালে আবডালে মোহ ভ্রান্তির ছায়া দীর্ঘ হয়।
এই যে কালের নিশ্চুপ অনুষ্টুপ ধুন্দুভি বাজছে নিরবে, নিঃশব্দে বইছে স্রোতধারা এ ধরা দেবে কিভাবে শব্দে-আদৌ যাবে কি?
প্রতিবিষ প্রতিরোধক ছড়িয়ে দেই রক্তে বারবার
তবু নিঃশব্দে আসে কালের মহাপাতক
বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জিবিত তন্ত্রি ক্রমশ বিকল
হারিয়ে যাওয়া প্রতিরোধ বহুজাতিক আগ্রাসনে
এমনই নিস্তেজ; খেই খাওয়া তেলাপোকা-মন
মিশে যায় স্রোতে, তবু আঘাত আঘাত
পাল্টা দেয়াল এখনই
গতি গতি আর তীব্রতা বারুদের স্ফুলিঙ্গ
প্রতিবাদ কোথায় চে’
টি-শার্টের আস্তিনে তুমি যে বেমানান
খোলস পাল্টাও জয় আমাদেরই-
বস্তুত কালের চিহ্নায়ন উজ্জ্বল নক্ষত্র
বস্তুত কালের চিহ্নায়ন উজ্জ্বল নক্ষত্র। কাল কিভাবে চিহ্নিত হবে, আগামির চোখে কিভাবে ধরা দেবে, ইতিহাসের বিচারে অনেক সময় টের পাওয়া যায় না। তাই বর্তমানের খলনায়ক ভবিষ্যতের মহানায়কে পরিণত হয় অনায়াসেই। পূর্বসূরিদের মূল্যায়ণ উত্তরসূরিরা ভুল বলে প্রতিপন্ন করে।
দ্যোতক বা অনুষঙ্গ হিসেবে ম্যালা বিষয়ই সক্রিয় অনুঘটক ব্যক্তি জীবনে। ব্যক্তি একক বলে সাধারণত বিষয়গুলো ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু সামষ্টিক হলে বিষয় ভিন্নমাত্রা পায়।
জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, কর্পোরেট পুঁজি নিয়ে ধন্দ কাটে না, মনোজগতে প্রভাবক শক্তি হয়ে ঢেলে দেয়া হয় বিষ। বুর্জোয়া-পুঁজিবিশ্বের দোহাইয়ে ব্যক্তিকে করে ফেলার চেষ্টা চলে নিরন্তন নিঃসঙ্গ-একক। নিঃসঙ্গ-একক করে ফেলা গেলে অনেক দিক থেকে বাঁচা যায়। একক নিঃসঙ্গ ব্যক্তি হয় অস্থির। চিত্তচাঞ্চল্যের কারণে সে কখনো শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে পারে না- নিজস্ব সাহস নিয়ে। মিডিয়ার সাহায্যে নিরন্তন মগজ ধোলাইয়ের কারণে
চিন্তাশূন্য-অথর্ব-পঙ্গু সত্তা গড়ে ওঠে। সে সহজেই বিশ্বাস করতে চায়। প্রভু হয়ে ওঠে কর্পোরেট খেইল; ভার্চুয়াল জগতের অদৃশ্য হাত ক্রিয়া করতে থাকে সমানে।
আর এক্ষেত্রে সহজ টার্গেট সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ। আগ্রাসন চালানো হয় কৌশলে ধীরে ধীরে। দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যের স্বার্থে এমন কিছু কোড আবিষ্কার করা হয় যাতে আখেরে ফল ভাল হয়। বাণিজ্য করতে গেলে একটা ভাষা বাচনভঙ্গি আনতে হয় যা টার্গেট পিপল বা দর্শকরা চেনে, বোঝতে সুবিধে হয়, সহজে মর্মে প্রবেশ করিয়ে দেয়া যায়। মাধ্যম নিয়ে গবেষণা চলে তাই নিরন্তর।
আর টেলিভিশনের চাইতে এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভাল মাধ্যম আছে কি? উত্তর-পুঁজির একটি বিশেষ চরিত্র নিম্নবর্গিয় বা নয়াবাজার অর্থনীতির ভোক্তা নয় এমন বিষয়ির বিনোদনের প্রকরণগুলির স্বীকরণ ঘটানো। যাদের এতদিন ভোক্তা ভাবা হয়নি, না ভাবলেও চলত, এখন তাদের ভোক্তার অধিকার দিতে হচ্ছে। বেশি সংখ্যক মানুষ যেহেতু ঊনিশ শতকিয় ইউরোপিয় আধুনিকতার ক্ষমতায়নের বৃত্তের বাইরে, প্রাক-পুঁজিবাদি লোক-বিনোদনের উপভোক্তা, তাই এখানে সাংস্কৃতিক পরিচায়নের স্পষ্ট সমস্যা রয়েছে। খবর বা খবরভিত্তিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে হয়ত সংকট ভিন্ন, নাচ-গান অভিনয়ের চাইতে। মধ্যবিত্ত জনগণ এমন এক ঐতিহাসিক অবস্থানে অবস্থান করে যেখানে তৃপ্তির দ্বিমাত্রিকতা সবচেয়ে বেশি। তাই দেখা যায় টেলিভিশনে ঐতিহাসিক বা রূপক পৌরাণিক সিরিয়ালগুলো জনপ্রিয়তা পায়। এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে আলিফ লায়লা, সোর্ড অব টিপু সুলতান, আকবর দ্য গ্রেট, আলিফ লায়লা এধরনের অনুষ্ঠানগুলোর কথা। ধর্মিয় আবহের নাটকগুলোও জনপ্রিয়তা পায়। মাধ্যম হিসেবেও একে গ্রহণ করা হয় ব্যাপকভাবে। ফাঁকে ফাঁকে কৌশল পুঁজির অবাধ বিপণন, বিজ্ঞাপন তেসেলমাতি, মগজের কোষে চেষ্টা চলে উপনিবেশ স্থাপনের।
আর তৃতীয় বিশ্বই যেন উচ্ছিষ্ট-উপনিবেশ, বিশৃঙ্খল, হা-ঘরে, অলস, ট্রাইবাল। ফ্রেডরিক জেমসন প্রমুখ বলবার চেষ্টা করেছেন, তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যও উপনিবেশিক মেটাফর। এবিষয়ে প্রাক্তন উপনিবেশসংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, বর্ণনা ব্যাপার কি জ্ঞানতাত্তি¡ক ও অবধারণা হিসেবে নিরপেক্ষ হতে পারে। বর্ণনা মানেই তো একটি অর্থবোধকতার বা মানের অবস্থানকে স্পষ্ট করা। জ্ঞানের উদ্দেশ্যকে রূপ দেয়া; বিভ্রান্তি ছড়ানো নয়। দীর্ঘদিন ধারণা দেয়ার চেষ্টা চলেছে, বর্ণনা ব্যাপার তো উপনিবেশের মালিকের, সে কিপলিং হোক বা হোক ম্যাক্সমুলার। ইস্টইÐিয়া কোম্পানি এসেই, সব তফাৎ বৈচিত্র্য রহস্যময়তা মুছে ফেলে ভারতিয় বলতে কি বোঝায়, বাঙালি বলতে কি বোঝায়, তার একটা সাধারণিকৃত মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। পাঞ্জাবি যোদ্ধার জাত বাঙালি নয় উপনিবেশিক এই মিথ্যা ভারতিয় উত্তর-উপনিবেশিক এস্টাবিøশমেন্টেরও প্রথম পাঠ। পৌত্তলিকতা খারাপ এই ভাবনা সাম্রাজ্যবাদি সেমেটিক চিন্তাপ্রসূত এবং একে প্রত্যয়সিদ্ধ করতে বাঙালি ভাবুক এখনও সমান উদ্বিগ্ন। একটি পাঠবস্তুকে অপরিহার্যভাবে বর্ণনামূলক ছাপ দেয়ার মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে চালান করা হয় শাসকের নিজস্ব অভিব্যক্তি, চিন্তা, ধ্যান-ধারণা। চেষ্টা চলে দার্শনিক ভিত্তি দেয়ার যার ওপর দাঁড়িয়ে এই মিথ্যাচার করা চলে অবাধে। উপনিবেশের মহাশক্তিধর শাসনকারিদের চেষ্টা উত্তর-উপনিবেশিক জমানায়ও সমান ক্রিয়াশিল; এখনো প্রতিটি সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্ত¡শাসিত প্রতিষ্ঠান, পুলিশ চিন্তা-চেতনা-ক্রিয়ায়-কার্যে উপনিবেশিক, অংশত অথবা সম্পূর্ণ মননে।
তৃতীয় বিশ্বের রচনামাত্রেই জাতিয় অ্যালেগরি, জেমসন যখন এবিষয়ক ভাষ্য প্রণয়ন করেন, তখন তিনি প্রথম বিশ্বের পরিভাষাটি উৎপাদন ব্যবস্থা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করেন। তৃতীয় বিশ্ব নামক শব্দটিকে পরিভাষিত করেন আপন খেয়ালে। দ্বিতীয়ত, তিনি এও বলছেন যে, পশ্চিমের উন্নত ভাষা সাহিত্য অ্যালেগরি অলঙ্কারটি দুশো বছর আগে পরিত্যক্ত হয়েছে। প্রথম তর্ক অনুযায়ি, প্রথম বিশ্বটির ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে মানবেতিহাসকে এবং তৃতীয় বিশ্বের ক্ষেত্রে দেয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ পৃথিবীটা এমনভাবে ভাগ করা যে একদল লোক ইতিহাস তৈরি করে যখন কিনা আরেকদল মানুষ সেই ইতিহাসের কাঁচামাল। মজার ব্যাপার হল পেরেস্ত্রৈকা আর গ্রাসনস্তের পর পৃথিবীকে তিনটে বিশ্বে ভাগ করার উপনিবেশিক চেষ্টাই মাটি হয়ে গেল। উত্তর-উপনিবেশিক চিন্তক মলয় রায়চৌধুরী ভারতিয় প্রেক্ষাপটে বিষয়টি দেখেন ভিন্নভাবে। তার ভাষায়, উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর চোখে পুঁজিবাদি দেশ হিসেবে ভারতবর্ষের লেবেল তো অন্যরকম হওয়া উচিত। কিন্তু না। আণবিক বোমা ফাটালেও, ক্ষেপনাস্ত্র বানালেও, ইউরোপ আমেরিকাকে সর্বাধিক উচ্চশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ সরবরাহ করলেও, ইস্পাতশিল্পের শতবার্ষিকি হলেও, তার নিজস্ব বহুজাতিকস্বর বহু দেশের বাজার কব্জা করে ফেললেও, ভারতবর্ষ আসলে উত্তর-উপনিবেশিক, তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র। ইউরোপ-আমেরিকায় ভারতবর্ষের বিষয়ে বলতে-লিখতে গেলে, টিভি-সিনেমা-নাটক দেখাতে গেলে, উপনিবেশিক অবধারণায় নিশ্চিতভাবে চাই-সাপুড়ের দড়ির খেলা, পাঁগড়ি পরা মহারাজা, ব্রিটিশ রাজত্বের ক্যাপ্টেন কর্নেল, ঝুঁকে থাকা চাকর বা আমলা, রাস্তায় ধর্মের ষাঁড়, হাফল্যাংটো সাধু। নৈতিকতার দোহাই দিয়ে সব রকমের অসৎ কাজ চালাবার অধিকার অর্জন করতে চেয়েছে তারা। সচেতনভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এককালের বাম আন্দোলনের কর্মি-চিন্তক-বুদ্ধিজীবী অধিকাংশই আজ মূল্যবোধহীন ও অসৎ। কর্তব্য নির্ধারণে বিভ্রান্ত, পরাক্সমুখ, অনিশ্চিত গন্তব্যের পথিক, স্বপ্নভঙ্গের নীলনেশায় পরাভূত-পরাস্ত অথবা ধ্বংসপ্রাপ্ত। ব্যক্তিস্তর মূল্যবোধহীনতার প্রতিযোগিতায় বুদ্ধিজীবীরা যেন আরো বেশি অগ্রসর। এককালের বাম-কমিউনিস্ট আদর্শের সৈনিক ভোল পাল্টে সহজেই মিশে যায় দুর্নীতিবাজদের মিছিলে, নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে পেটায় বুর্জোয়া রাজনীতির ঢোল; হন কর্পোরেট পুঁজিমাহাত্ম্যের প্রথমশ্রেণির গুণকীর্তক। বাংলাদেশের বড় বড় এনজিওর প্রতিষ্ঠাতা তথা মালিক তারাই অর্থাৎ একসময়ের কমিউনিস্ট আদর্শের সৈনিক। বামদের এই অধঃপতন লুম্পেনচরিত্রকেই জাতিয়করণ করে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের শ্রেণিচৈতন্যের খোলস কত ঠুঁনকো। ফলে অনিবার্যভাবে সত্য দাঁড়ায় এই বামরাজনীতির সুফল পায় বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো; যেকোন সফল সংগ্রাম আন্দোলনের সুফল ভোগ করে প্রতিপক্ষ বৈরিশক্তি। ডিগবাজি খাওয়ার কারণেও বামদের আবেদন-নিবেদন কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের কানে পৌঁছায় না, অন্যভাবে বললে তাদের বিশ্বাস করে না সাধারণ মানুষ।
উত্তর-উপনিবেশিক ধারণায় প্রচ্ছন্নভাবে বলা হচ্ছে বেছে নেবার জন্যে দুটি পথ খোলা স্পষ্টত: স্বাদেশিক জাতিয়তাবাদ কিংবা আন্তর্জাতিক পোস্টমডার্ন সংস্কৃতি। যেন, তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম কিংবা বিকল্প আর কোনো পথ নেই। যারা মার্কসবাদি তাঁরা বলেন, আরেকটা পথ ছিল উত্তর-উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর জন্যে-সমাজবাদের পথ। তাও বেমালুম উবে গেল সোভিয়েত কাঠামো ভেঙে পড়ার পর। অনেকে বলেন, পুরো ব্যাপারটিই মহাআখ্যানবাদি চিন্তানির্ভর। বানানো গল্প, ইতিহাস একটি কল্পনা ছাচে ঢালাই করা, ফলত একরৈখিক। উৎপাদন ব্যবস্থার পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে একটি সমাজকে পরিভাষিত না করে যদি রাষ্ট্রের ভেতরকার সম্পর্ক দিয়ে পরিভাষিত করতে হয়-শ্রেণি, লিঙ্গ, রাষ্ট্র, জাতি, ধর্ম ইত্যকার পারস্পরিক সংঘর্ষ ও সংগ্রামের পরিবর্তে অভিজ্ঞতাই হয়ে ওঠে প্রধান ভিত্তি, তাহলে মানুষ হয়ে দাঁড়ায় চৈতন্যে দীন, মননে চাকর।
তিন বিশ্বের ধারণা গ্রহণযোগ্য কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অবশ্য। উপনিবেশ আর সাম্রাজ্যবাদের অভিজ্ঞতা তো কেবল অনুন্নত দেশগুলোর নয়; ওই অভিজ্ঞতা থেকে ছাড়া পায়নি একদা যারা সাম্রাজ্যের মালিক ছিল তারাও।
তৃতীয় বিশ্বের ধারণায় এসেছে প্রথম বিশ্বের পক্ষ-প্রতিপক্ষ বিভাজন। অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে তৃতীয় বিশ্ব নামের এলাকাটিকে দলা পাকিয়ে দেয়া হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার নিজেদের মধ্যে কোনো মিল নেই। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের তফাৎ অনেক। মলয় রায়চৌধুরী চমৎকার উদাহরণ দেন এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রিটেনের অনেক কিছু মিলে যাবে হয়তো কাকতালিয়ভাবে কিন্তু আর্জেন্টিনার সঙ্গে মিলবে না কিছুই। ভিয়েতনাম কোনোদিনই তার সংস্কৃতি থেকে আমেরিকাকে মুছতে পারবে না। কেননা অজস্র ভিয়েতনামি জন্মেছে আমেরিকান ঔরস্যেই। ভিয়েতনাম যতটা আমেরিকার কাছাকাছি ততটা আলজেরিয়ার কাছাকাছি নয়। এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর আন্তর্জাতিক পুুঁজিবাদি কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির অভিজ্ঞতাও আলাদা। এর দরুণ সেসব দেশের মধ্যে যে রদবদল ঘটছে তাও আলাদা। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের তৃতীয় বিশ্ব নামের একরূপতায় ঢেলে ফেলার ঝোঁক আছে। ইউরোপ-আমেরিকার মূল্যবোধহীনতাকে উত্তর-উপনিবেশিক দেশগুলির মূল্যবোধহীনতা থেকে পৃথক করার চেষ্টায় এশিয় দেশগুলির আর্থিক উন্নতিতে খুঁজে বের করা হচ্ছে নানা দুর্নীতির ছুতু।
অস্বীকার করবার উপায় নেই উচ্চ বর্ণোদ্ভূত বাঙালি লেখকগোষ্ঠির ওপরে গান্ধিজির প্রভাব তিরিশের দশক থেকে উর্ধ্বগামি হয়েই ছিল, সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা ও বলশেভিক বিপ্লব, জাতিয় রাজনীতিতে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে গান্ধিজির বিরোধ, সন্ত্রাসবাদি রাজনীতির ধারা যত জিজ্ঞাসাই জাগিয়ে তুলুক না কেন, গান্ধি প্রদর্শিত দিক-নির্দেশনাই থেকে গিয়েছিল বড় আশ্রয়ের জায়গা হয়ে, যে কারণে বাঙালি লেখকরা ঊনবিংশ শতাব্দির মানবতন্ত্রি চিন্তাধারায় আপ্লুত হয়ে গোটা তিরিশের দশক ধরে নিম্নবর্গিয়দের কথা কর্ণপাত করেননি, করবার প্রয়োজনও মনে করেনি। উচ্চবর্গিয়দের সাথে বিরোধ ছিল প্রকাশ্য, সূচ্যগ্র ক্ষমতার জমি ছাড়তেও নারাজ ছিলেন সবাই। উচ্চবর্ণের হৃদয়জাগরণের মধ্য দিয়েই সামাজিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা হবে, এই ধারণাতেই তারা ছিলেন মশহুর। তারা মনে করতেন নিম্নবর্গিয়দের সমস্যার সমাধান হবে সামগ্রিকভাবে জাতিয় মুক্তির মধ্যেই। এক্ষেত্রে মুসলমান উচ্চশিক্ষিত কিংবা রাজনীতিকদের অবস্থা ছিল আরো করুণ, আদতেই তারা কোন মূল্যবোধ-দর্শন দাঁড় করাতে পারেননি নিজেদের স্বপক্ষে। নিজেদের প্রতিপক্ষ নিজেকে করে সবকিছুতেই পলায়ণপর মনোবৃত্তি গ্রহণ করলেন, ইংরেজ-ইংরেজি শিক্ষা বর্জনের নামে আধুনিক শিক্ষা থেকেও রইলেন বিমুখ। স্বদেশি ভারতিয় হিন্দুদের থেকেও পিছিয়ে পড়ল মুসলমানরা হঠকারি নীতি-সিদ্ধান্তের কারণে। উচ্চমার্গিয় অহং,
বাস্তবজ্ঞানশূন্যতা, সামর্থ্য না জেনেই অন্যের সমালোচনা তাদের পিছিয়ে দিল আরো। এদেশে জন্ম বেড়ে ওঠা অথচ নিজেদের অস্তিত্ব অন্যত্র খোঁজে ফেরা জাতি হিসেবে করে তুলল মুসাফির মননে, বিজ্ঞানবিমুখতা আজো ভোগাচ্ছে আমাদের।
১৭৫৭ সনে সিরাজকে হারিয়ে মিরজাফরকে সিংহাসনে বসাবার পর ইংরেজরাই প্রচার চালায় মিরজাফর অকর্মণ্য, লোভি, নেশাখোর। শাসন করবার অনুপযুক্ত এটিকে ঐতিহাসিক সত্যতা দেয়ার জন্য সচেতন ডিসকোর্সও বানিয়ে ফেলেছিল তারা। নেটিভের ভাষা এবং ভাষার মাধ্যমে তার মস্তিষ্কে সাম্রাজ্যটি বসানোর উদ্দেশ্যে ১৭৭৮ সনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোং-এর হ্যালহেড প্রকাশ করেন ‘দি গ্রামার অব দি বেঙ্গল ল্যাংগোয়েজ’। ১৭৯৩ সনে আপজোন লিখিত ইংরেজি ও বাঙালি ‘ভোকাবুলারি’, ১৯১৭ সনে মিলার রচিত ‘শিক্ষা গুরু’, ১৭৯৯-১৮০২ সনে দুই খণ্ড ফরস্টারের অভিধান ‘ভোকাবুলারি’ একই স্বার্থে প্রকাশিত হয়। শ্রিরামপুর মিশন থেকে বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মপুস্তক বাংলায় বেরোতে থাকে ১৮০০ সনের পর যাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশিয় কোডগুলো নষ্ট করা, কেবল ধর্মান্তরিত নয়।
জনৈক মিশনারি জশুয়া মার্শমান ১৮৫৩ সনে আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, কালক্রমে বাঙালির ধ্রুপদি ভাষা হয়ে উঠবে ইংরেজি। উপনিবেশিক ব্যবস্থায়, পাশ্চাত্য শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে গভীর ভাবনাচিন্তা করা হয়েছিল। ধর্মশিক্ষা দেবার অসুবিধে ছিল বলে, ইংরেজি সাহিত্য থেকে যে গদ্যপদ্য নেয়া হত তার মাধ্যমেই শাসকশ্রেণির ধর্মের সারকথা পৌঁছে যেত ছাত্রছাত্রিদের মনে। দেশ স্বাধিন হওয়া অব্দি বজায় ছিল পদ্ধতিটি। শিক্ষা আধিকারিক আলফ্রেড ক্রফট ১৮৮৬ সনে, বাঙালি সমাজকে তাঁবে রাখতে স্কুল ঘরেই সিলেবাসের মাধ্যমে রাজভক্তি, আনুগত্য আর নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষার কথা বলেছিলেন। ধর্মিয় নৈতিক শিক্ষার মুলা দেখিয়ে আলোকিত সমাজ গড়বার দোহাই দিয়ে বিষয়টি এখনো চলছে ভালভাবেই, এই বাংলাদেশে।
উপনিবেশিকরা একথা বোঝতে পেরেছিল সহজেই শক্তি নয়, উপনিবেশ স্থায়ি দীর্ঘস্থায়ি করতে, সাম্রাজ্যের সিংহাসনটি বসাতে হবে নেটিভের মগজে। জিন্নাহ্ যখন দ্বিজাতিতত্ত¡ বা টু নেশন থিয়োরির কথা বলেন, তখন জাতি ব্যাপারটি নিজের মগজে গড়েছিলেন আগে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলাদেশ ঘোষণা করলেন তখনও জাতিচিন্তা তাঁর মাথায় কাজ করেছিল আগে।
উপনিবেশিক প্রভুদের শেখানো অনেক-অনেক ব্যারামের মধ্যে একটি হল গ্রন্থস্বত্ত¡ বা কপিরাইট, যা প্রাচ্যের ধারণায় মেলে না, ভারত বরাবরই স্বত্ত¡কে অপ্রয়োজনিয় বিষয় বিবেচনা করেছে। রামায়ণ মহাভারত ব্যক্তি নামে প্রচারিত হলেও এগুলো একক ব্যক্তির অবদান নয়, যৌথতায় লীন হয়ে গেছে একক ব্যক্তি কৃতিত্ব। সৃষ্টিকর্তা গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে সৃষ্টিকেই প্রাধান্য দেয়া হত বরাবর, ইংরেজরা আসার পর এই কোডটিও নষ্ট করে দেয়া হল চিরতরে, তার জায়গায় স্বত্ব আইনের ধারণা মগজে প্রোত্থিত হল।
অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন ছাড়া স্বাধিনতা অর্থহীন, তেমনি ব্রিটিশ প্রণিত উপনিবেশিক চিন্তাচেতনা কালাকানুন বহাল রেখে কতটা এগোনো সম্ভব বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা দরকার। সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ইশতেহার ছাড়া মুক্তির পথ অন্ধের হস্তি দর্শনের ন্যায় বিবেচিত হবে। নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ব্যক্তি স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে, সুযোগভোগি কিছু ব্যক্তির সুবিধা দেখা হলে কাজের কাজ কিছু না হওয়ারই কথা। তেল-গ্যাস-জ্বালানি ইস্যুতে অভিজ্ঞ জনদক্ষতার দোহাই, বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে নীতি প্রণয়ন আখেরে খারাপ ফলই আনবে তার সা¤প্রতিক উদাহরণ কম নয়। চোখ বন্ধ রেখে জেগে ঘুমানোর ভান জাতি হিসেবে আমাদের আরো পিছিয়ে দেবে, কেননা কর্পোরেট বুর্জোয়া পুঁজির অবাধ প্রবাহ, আন্তর্জাতিক-দেশিয় চর-দালাল সাম্রাজ্যবাদি শক্তি সদাতৎপর নানাভাবেই; সক্রিয় তাদের সহযোগি দেশিয় মিডিয়া পরিচিত কিছু ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান যাদের লালন করা হয় সাম্রাজ্যবাদি স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেই।
মহাকালের খাতায় কিভাবে চিহ্নিত হব তার প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই। জনযুদ্ধ অথবা বিপ্লব যুগে যুগে, শেষ হয় না কখনও, সাম্রাজ্যবাদি শক্তির পাল্টানোর সাথে সাথে পাল্টে যায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও।