অনুভূতিহীন সময়ে: ডাকে আর চিঠি আসে না
দ্বিজেনদা সত্যি সময়টা একেবারেই ভালো না যেমনটা আপনি বলেছিলেন: প্রকৃতি আর পরিবেশ নিয়ে আমরা যারা কথা বলি শোনে না কেউ আর এখন আমাদের কথা; ঠেকাতে পারলাম কই বলো একটাও অন্যায় অন্যায্য প্রকল্প। টিপাই হবে হবে করছে, একটার পর একটা নদি সিলগালা। ফারাক্কা শুকিয়ে গেছে, তিস্তা মরো মরো। পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা… সারি’র কি অবস্থা…
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে… সংরক্ষিত বনাঞ্চলে চলছে পিকনিক, হুলোর, ধ্বংস, মহোৎসব, লাউয়াছড়া কি মরে যাবে… শুনেছি সুন্দরবনে বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে। বনের দরকার কি এই আকালের দেশে… আগে তো খেয়েপড়ে বাঁচতে হবে… প্রকৃতি বাঁচাও নদি বাঁচাও… আঙুল চুষো…
চিঠি দিও চিঠি দিও নইলে বাঁচবো না আর… চিঠি লিখে কে আর এখন…
ইমেইলে আসে যৌনকর্মির আহ্বান… আমি … তোমার প্রোফাইল পড়লাম… মনে হলো তুমি খুব চমৎকার মানুষ… কিন্তু নিঃসঙ্গ… আশাহত… আমাকে বন্ধু হিসেবে পেতে পারো… কয়েক রাত… কিংবা কয়েক ঘণ্টা… কথা দিলাম তোমার খারাপ লাগবে না…
চমক… এই আশাহত সময়ে একজন ডাকসাইটে আমলা নয়, ব্যবসায়ি-শিল্পপতি নয়… একজন সামান্য লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক বরাবরে এই অপূর্ব চিঠি…
বুঝলে সুকন্যা, সত্যি আমি খুব নিঃসঙ্গ আশাহত… আমার একজন সঙ্গি দরকার যে কয়েক মুহূর্তের জন্য রঙিন দুনিয়ায় নিয়ে যাবে আমাকে…
দ্বিজেনদা আসুন আমরা সুকন্যার আহ্বানে সাড়া দেই…
রিসি দলাই/ ২৯ জুলাই ২০১৩
বিকল্প বের করতে হবে
রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা ভয়াবহ। গুটিকয় দল, নেতা-কর্মির কাছে পুরো দেশ জিম্মি হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিখেয়াল, স্বেচ্ছাচারিতায় বন্দি গোটা দেশ। লাম্পট্য, লুণ্ঠন, জিম্মি, জ্বালাও-পোড়াও নাটকের প্রহসন চলছে সমানে। মানুষ হচ্ছে এর নির্মম শিকার। বেশ ক’বছর ধরে দেখা যাচ্ছে-বিদেশি কিছু দালাল, মিডিয়া, সুশিল সমাজ বলপূর্বক রাজনীতিতে পরিবর্তন আনবার চেষ্টা করছেন। তাদের বলবার চেষ্টা দুটো বড় দল যতো নষ্টের মূলে। কিন্তু আমাদের পর্যবেক্ষণে ভিন্ন উদ্দেশ্য প্রমাণিত। বিদেশ নির্ভরতা, বিদেশি দালাল-মোসাহেবের মাতব্বরি, সাম্রাজ্যবাদি প্রবণতা, লুটেরাশক্তির উত্থান, বিদেশি শক্তির স্বার্থে কাজ করার স্থূল মানসিকতা, উর্বর মস্তিষ্ক দালাল-বুদ্ধিজীবীর কু-পরামর্শ পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দিচ্ছে। সৃষ্টি করা হয়েছে দল-উপদলের (যদিও এই দল-উপদল নিয়ে মোটেও চিন্তিত নই আমরা)। আগামি ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে একটি বড় মৌলিক (গুণগত) রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হবে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের প্রজ্ঞা-মেধা দিয়ে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে পারছেন না। আগামির পরিকল্পনা এখনি নিতে হবে এবং রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। বর্তমান এই অরাজক সময়ে সাম্রাজ্যবাদি লুণ্ঠনবাদি আগ্রাসি শক্তিগুলোকে প্রতিরোধ করতে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে, প্রয়োজনে বিকল্প ফ্লাটফর্ম প্রস্তুত করতে হবে।
আবার টিপাইমুখ: আমরা কেন এর বিরোধিতা করছি
ভারতের নির্মাণাধিন টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে বাংলাদেশের যে উদ্বেগ ও বিতর্ক তারও কেন্দ্র হাওড়াঞ্চল। এ পর্যন্ত পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট, বিভিন্ন বুলেটিনসহ নানা মাধ্যমে যেসব মতামত পাওয়া গেছে আমাদের বিবেচনায় এগুলোকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
এক. বিভিন্ন পরিবেশবাদি সংগঠনের মতামত-নীতিগতভাবেই এরা বড় বাঁধ বা ড্যামের বিরোধি। এরা বিশ্বাস করেন প্রকৃতিবিরোধি কোনও কর্মকাণ্ডই শেষ পর্যন্ত মানুষের কল্যাণে আসে না, সাময়িকভাবে লাভজনক মনে হলেও এগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি অপরিমেয়। টিপাইমুখ বাঁধও তার ব্যতিক্রম নয়। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এ বাঁধ থেকে লাভবান হওয়ার কোনও হেতু নেই।
দুই. পরিবেশবাদিদের বাইরে, আমাদের দেশের যেসব বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন তারাও বিভিন্নভাবে এ বাঁধ থেকে আমাদের কি কি ধরনের ক্ষতির আশংকা রয়েছে তারই বিশ্লেষণ করেছেন।
তিন. এই দুই ধরনের বিরোধিতার বাইরে কিছুদিন আগেও আরেক ধরনের বিরোধিতা লক্ষ্য করা গেছে তাহলো রাজনৈতিক বিরোধিতা। সরকার এবং সরকার সমর্থক দল ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই টিপাইমুখ বাঁধের বিপক্ষে তাদের অবস্থান জানাতে নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে হরতাল, লংমার্চ, সবই ছিল। তবে এ ধরনের প্রতিবাদ জানানো ব্যতিত সত্যিকার অর্থে এ বাঁধের ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষার জন্য করণিয় বিষয়ে তারা নিশ্চুপ থেকেছে এবং বর্তমানে তো একেবারেই নিশ্চুপ।
টিপাইমুখ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন কেন
এক. বাংলাদেশের দুটি বড় নদির সরাসরি উৎস হচ্ছে বরাক নদ, যার ওপর নির্মিত হবে টিপাইমুখ ড্যাম। বরাক নদ সিলেট সিমান্তের অমলশিদে এসে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে একটি নাম নিয়েছে সুরমা, অপরটি কুশিয়ারা। সুরমা ও কুশিয়ারা বৃহত্তর সিলেটের প্রাণ, এ দুটি নদি নানা শাখা-নদি দিয়েও সিলেটের হাওড়গুলোতে পানির যোগান দিয়ে যাচ্ছে। এসব বড় হাওড় আবার অনেক ছোট হাওড় ও বিল-বাঁওড়ে পানি যুগিয়ে থাকে এবং ছোট-বড় এই হাওড়-বিলই জীববৈচিত্র্যের উৎস ও শস্যভাণ্ডার, যেমন হাকালুকি, শনির হাওড়, মাটিয়ান হাওড় ইত্যাদি। তাছাড়া সুরমা-কুশিয়ারা ভৈরবে এসে মেঘনা নামে বিশাল জলধারা হয়ে পানির যোগান দিচ্ছে কিশোরগঞ্জসহ বিস্তির্ণ এলাকায়। মেঘনার সঙ্গে সম্পর্কিত কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনার হাওড়-বাঁওড়, নদিনালা। বলতে হয়, বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল তথা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভিবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ এই ৭টি জেলা তার হাওড়গুলোর জন্যই অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। হাওড় এই অঞ্চলকে জীবিকা ও প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে দিয়েছে সংস্কৃতি ও সাহিত্য। রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম, জালালসহ অনেক গায়ক-শিল্পি তৈরি হয়েছে হাওড়ের জনপদে। তাই টিপাইমুখ ড্যাম হয়ে উঠতে পারে একটি বিশাল অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য সম্পদ, নৌ-চলাচল ও জীববৈচিত্র্য তথা সমৃদ্ধ সংস্কৃতি হত্যার হাতিয়ার।
দুই. টিপাইমুখ ড্যাম কাজ শুরু করার পর এর একশ কিলোমিটার নিম্নে তৈরি করা হবে ফুলেরতল ব্যারেজ। ড্যাম নির্মাণ সম্পন্নের পর বরাকে ৩১ শতাংশ পানি আটকে রাখা হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এবং ফুলেরতল ব্যারেজ নির্মিত হওয়ার পর বরাক প্রবাহের শতভাগ পানির নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে ভারত সরকারের হাতে। ফুলেরতলে যে ব্যারেজ নির্মিত হবে সেই কথা দিবালোকের মতোই সত্য। কারণ টিপাইমুখ ড্যামে বিনিয়োগকৃত হাজার হাজার কোটি রুপি তুলতে গেলে ফুলেরতলে ব্যারেজ বানিয়ে তার সেচ সুবিধা থেকেই তা গুণতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরাকের বাংলাদেশ অংশ তথা সুরমা-কুশিয়ারার স্রোতের গতি ও বালু বহনের ক্ষমতা পদ্মার চাইতেও বেশি। টিপাইমুখ ড্যাম হলে নদিগর্ভে বালি কিংবা পলি সঞ্চালনের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এতে করে বছর কয়েকের মধ্যেই বালুস্তর জমে সিলেট অঞ্চলের হাওড়-বাঁওড়, নদিনালা ভরাট হয়ে যাবে। এতে করে ধ্বংস হবে কৃষি। সুরমা-কুশিয়ারা ভরাট হলে টান পড়বে মেঘনার অস্তিত্ব নিয়েও।
তিন. শুকনো মওসুমে নদিকেন্দ্রিক জনপদ এবং হাওড়কেন্দ্রিক জনপদের অবস্থা ভিন্ন থাকে। রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের নদিগুলোতে শুকনো মওসুমে পানি ছাড়লে সেটিতে লাভ এবং তা প্রয়োজন। কিন্তু হাওড় অঞ্চলের নদিগুলোতে তা হবে আত্মঘাতি। কারণ শুকনো মওসুম তথা হেমন্ত, শিত ও বসন্তের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে টিপাইমুখ ড্যাম থেকে জল ছাড়া হবে আর ওই সময়ে হাওড়গুলো জেগে ওঠে ও ফসল ফলে। এসময় প্রথমে হাওড়ের জেগে ওঠা উঁচু ভূমিতে বিজ বপন করা হয়, সেগুলো এক-দেড়মাস পরে চারা তথা জালা হয় এবং জালা হওয়ার পরে নিম্নভূমি ততদিনে জেগে উঠলে সেখানে রোপণ করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ার সময় হাওড়গুলোর পানি নদির মাধ্যমে নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু টিপাইমুখ থেকে ওই সময়ে যখন পানি ছাড়া হবে তখন হাওড়গুলো জেগে উঠতে পারবে না। ফলে বোরো ধান ফলানোও অসম্ভব হয়ে পড়বে। তথা ওই দিনগুলোতে টিপাইমুখ থেকে পানি ছাড়ার ফলে নদির পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় নদি আর হাওড়ের পানি নিষ্কাশন করতে পারবে না, উল্টো এমনও হতে পারে যে, নদির পানি হাওড়ে গিয়ে ঢুকবে। এ কারণে হাওড়গুলোতে আর ফসল ফলানো যাবে না।
চার. টিপাইমুখ ড্যাম দিয়ে আগাম বন্যানিরোধের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে গিয়ে ড্যাম সবসময় পূর্ণ করে রাখতে হয়। ড্যামের গঠন অনুযায়ি অতিবৃষ্টিতে পানি কেবল স্পিলওয়ে দিয়ে উপচেপড়ে ভাটিতে যায়। যেমন হচ্ছে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে বর্ষার বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরাক অববাহিকায় অতিবৃষ্টিপাত ঘটলে সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ঠিকই, তবে অতিরিক্ত পানি আটকে না রেখে বিকল্প পথে তা নিকাশ করতে হবে। ফলে নিম্নাঞ্চলে বন্যারোধ করা সম্ভব হবে না।
পাঁচ. টিপাইমুখ বিশ্বের একটি বৃহৎ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ভূমিকম্পন যদি বাঁধ ভেঙে দেয় তাহলে এই বিলিয়ন বিলিয়ন ঘনমিটার পানি শুধু মণিপুর বা কাছাড়ে আটকে থাকবে না। বছরের অন্যান্য সময়ে শান্ত থাকলেও বরাক ও এর শাখা-নদিগুলো মওসুমি বৃষ্টিপাতের সময় স্রোতস্বি হয়ে ওঠে। ভূপ্রকৃতিগত কারণেই বাংলাদেশের সিলেট ও পার্শ্ববর্তি মণিপুর অঞ্চলে বর্ষাকালজুড়ে অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। সাধারণভাবে এই বৃষ্টিপাতের ৬০-৭০ ভাগ হয় জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে। বিপরিতে বছরজুড়ে কার্যকর রাখতে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রকে মে-জুনের ভেতরে পূর্ণ পানি ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে বাঁধের ভাটি অঞ্চল তথা মণিপুর ও বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেবে।
ছয়. একইভাবে টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মওসুমে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর হিসাব দেয়া হচ্ছে পরিত্যক্ত ফ্যাপ রিপোর্টের বরাত দিয়ে যে, টিপাইমুখ ড্যাম নির্মিত হলে অমলশিদে পানির সর্বোচ্চ প্রবাহ শতকরা ১০০ ভাগ থেকে ২০০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে এবং পানির পরিমাণ বাড়বে শতকরা ৬০ ভাগ। অন্যদিকে টিপাইমুখ প্রকল্পের পরিবেশগত রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাঁধের কারণে শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহ ১১০ ভাগ বাড়বে। পরিত্যক্ত ফ্যাপ রিপোর্ট মতে, এই বর্ধিত প্রবাহ নৌ চলাচল, সেচ ও মৎস্যচাষে বৃদ্ধি ঘটাবে। এখানেও আমাদেরকে নদি অঞ্চল ও হাওড় অঞ্চলের ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে হচ্ছে। বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলে ওই সময় পানির প্রবাহ বেড়ে গেলে ফসল ফলবে কি করে? হাওড় শুকিয়ে গেলে মানুষ যেমন বোরো ধান রোপণ করে, তেমনি হাওড় শুকনো থাকতে থাকতেই বোরো ফসল ঘরে তোলে।
সাত. ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, টিপাইমুখ ড্যাম থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ-মতে, বাস্তবে ২০০-২৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে না। এ কারণে বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ রপ্তানির কথা ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের কারও কারও পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তা-ও এক অবাস্তব ব্যাপার। তাছাড়া এই দুই-আড়াইশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশের এক বিশাল অঞ্চলের মানুষ, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীবন-জীবিকা, প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ-প্রকৃতি হুমকিগ্রস্ত হবে, তা কারও পক্ষেই মানা সম্ভব নয়।
আট. একইভাবে আসে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি। বাংলাদেশের হাওড়াঞ্চল দেশের ১৬ কোটি মানুষের মোট খাদ্যের এক-পঞ্চমাংশের যোগান দিয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞ-মতে, টিপাইমুখ ড্যামের অভিঘাতে শুধুমাত্র সিলেট অঞ্চলেই ১৫ হাজার কোটি টাকার ফসল থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্ববর্তি শিক্ষা থেকে যে খাদ্যনিরাপত্তা গড়ে তুলতে চাইছে, তা-ও অসম্ভব থেকে যাবে।
যৌথ সমিক্ষা নয় প্রয়োজন একটি আন্তর্জাতিক সমিক্ষা
বস্তুত, বাংলাদেশ এবং উত্তরপূর্ব ভারতের মানুষের প্রতিবাদের কারণে বাধ্য হয়ে দুদেশের সরকার যৌথ সমিক্ষায় সম্মত হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারই যৌথ সমিক্ষার প্রস্তাব দিয়েছিল। এরপর ভারত সরকার তা গ্রহণ করে এবং এ উপলক্ষে গত ২৭ আগস্ট (২০১২) দিলিতে ভারত-বাংলাদেশের সরকারি তরফের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যৌথ সমিক্ষা বৈঠক হয়। এই যৌথ কমিটির বৈঠকের পর কয়েকটি বিষয় ঘটে, প্রথমত, বাংলাদেশের সরকারি তরফ থেকে বৈঠক সম্পর্কিত আনুষ্ঠানিক কোনও ভাষ্য-বিবৃতি আমরা পাইনি, যতটুকু পাওয়া গেছে তা সংবাদপত্র মারফত। যার মোটমাট কথা হলো, ভারত টিপাইমুখ সংক্রান্ত নথিপত্র বাংলাদেশের হাতে তুলে দিয়েছে। এরপর ৭ই সেপ্টেম্বর (২০১২) বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের বরাত দিয়ে এরকম খবর প্রকাশিত হয় যে, দিলি সফরকালে বাংলাদেশের টিম সদস্যদের টিপাইমুখ ড্যাম সম্পর্কিত কোনও তথ্য-উপাত্তই দেয়া হয়নি। একজন টিম সদস্য বলেন, ‘তথ্য-উপাত্ত দূরের কথা, আমাদের টিপাইমুখ ড্যাম বিষয়ে এক পৃষ্ঠার একটি কাগজও দেয়া হয়নি। আমরা নয়াদিলি গেলাম, চারদিন বেড়ালাম। ভারতিয় টিমের সঙ্গে ক’টি বৈঠকে মিলিত হলাম। তারা আমাদেরকে মৌখিকভাবে টিপাইমুখ বাঁধের উপকারিতা সম্পর্কে বললেন। এরপর আমরা ফিরে এলাম।’
তাছাড়া যৌথ সমিক্ষা দল গঠনের আগেই এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, ভারত সরকার এবং বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নয়। কোনও গ্রহণযোগ্য সমিক্ষা ছাড়াই ভারত সরকার টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে লাভই দেখতে পেয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ সরকারও ভারত সরকারের ওপর আস্থা দেখিয়ে বলেছে যে, টিপাইমুখ ড্যামে বাংলাদেশের কোনও ক্ষতি হবে না। তাছাড়া বাংলাদেশের সরকার পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে টিপাইমুখে উৎপাদিত বিদ্যুৎ থেকে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে বলে। এ কারণে এ আশংকা অমূলক নয় যে, লোক-দেখানো যৌথ সমিক্ষা চালিয়ে টিপাইমুখ ড্যামকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা চালানো হবে। এবং এ সমিক্ষা থেকে টিপাইমুখ ড্যামের অভিঘাত নিয়ে প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে না এবং কথিত এই সমিক্ষার ওপর আস্থা রাখার কোনও সঙ্গত কারণ নেই। তাছাড়া ফারাক্কার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। তাই আমাদের বক্তব্য হলো, ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের কি ক্ষতি ঘটেছে এবং বাংলাদেশে পরিবেশ-উদ্বাস্তু কত সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে আগে তা নিরূপণ ও প্রশমিত করা জরুরি।। আর যতদিন না ফারাক্কার ক্ষতি নিরূপিত ও প্রশমিত এবং টিপাইমুখ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমিক্ষা না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত টিপাইমুখ ড্যামের কাজ স্থগিত রাখা হোক।
১. টিপাইমুখ ড্যামের সম্ভাব্য অভিঘাত নির্ধারণের জন্য যৌথ সমিক্ষার বদলে একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সমিক্ষা পরিচালনা করতে হবে,
২. সমিক্ষার ফলাফল প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত ভারত সরকারকে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ কাজ স্থগিত রাখবে বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে হবে,
৩. হাওড়াঞ্চলের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে,
৪. আন্তর্জাতিক নদি কনভেনশনে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর করতে হবে এবং এ কনভেনশনকে আইনে পরিণত করার জন্য প্রয়োজনিয় বাকি দশটি দেশের স্বাক্ষর সংগ্রহে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।
সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই না
বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ অঞ্চল সুন্দরবনের কাছাকাছি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে পরিবেশবাদি বিভিন্ন সংগঠন, ভূপরিবেশ বিজ্ঞানি, উদ্ভিদ ও বন বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা তাদের যুক্তির স্বপক্ষে নানা তথ্য-উপাত্ত হাজির করেছেন। নানা গবেষণায় প্রতিফলিত হয়েছে বনধ্বংস তথা এর ক্ষতিকর দিকগুলো। আমাদের অন্যতম সম্পদ সুন্দরবন। শুধুমাত্র সৌন্দর্যের জন্যই নয়, সুস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্যও এই বন দরকারি। সুন্দরবন ধ্বংস হয় এমন কোনো প্রকল্প কিছুতেই বাস্তবায়ন হতে দিতে পারি না আমরা। সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, অন্যত্র কোনো সুবিধাজনক জায়গায় একে সরিয়ে নিতে উদাত্ত আহŸান জানাচ্ছি। সাথে সাথে বাংলাদেশের সকল সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অবাধ প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধের দাবি জানাই।
সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে
বিগত কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশে হে সাহিত্য উৎসব হচ্ছে। আমরা এর বিরোধিতা করি না, কিন্তু বাংলা একাডেমি যখন এর সাথে যুক্ত হয়ে একাডেমি প্রাঙ্গণে এই উৎসব আয়োজনে সমঅংশিদার হয় তখন একে ধিক্কার-নিন্দা না জানিয়ে পারা যায় না। আর কে না-জানে হে উৎসবের আসল মাজেজা। উপনিবেশগুলোতে সাহিত্য তথা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানোর প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য থেকেই এই উৎসবের সূচনা। বাংলা ভাষার মননের প্রতিক বাংলা একাডেমি একটি লুণ্ঠন-অভিপ্রায়ি ব্যবসায়িক গ্র“পের সাথে মিলেমিশে এই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করছে। হায় বাংলা একাডেমি, হায় বাংলা ভাষা, হায় বাংলা সংস্কৃতি।
সংখ্যা সম্পর্কে দুয়েকটি কথা
এ সংখ্যার বিষয়: কবি নির্বাসন অথবা প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র। আড়াই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে প্লেটো চিন্তাজগতের একচ্ছত্র সম্রাট। প্রশংসা যেমন পেয়েছেন, নিন্দামন্দও কম জোটেনি। আদর্শ রাষ্ট্র থেকে শিল্পিদের নির্বাসন দিতে চেয়েছেন প্লেটো। চলতি সংখ্যার মাধ্যমে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চেয়েছি আমরা।
কাছের দু’জন কবি এরই মধ্যে বিগত হয়েছেন। একজন কবি দিলওয়ার এবং অন্যজন কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন। একুশে বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরের অংশে পরিণত হয়েছিলেন আশরাফ ভাই। শ্রদ্ধার অংশ হিসেবে ছাপা হলো তাঁদের গ্রন্থ বিষয়ক দু’টি আলোচনা।
বরাবরের মতো এই সংখ্যায়ও উলেখযোগ্য সংখ্যক নতুন লেখক ও কবি যুক্ত হলেন, তাদের পথচলা মসৃণ হোক।
পরবর্তি সংখ্যার বিষয়: ‘রাষ্ট্রের নৈতিকতা নির্ধারণ অথবা সন্দেশ সন্দেশ ভালোবাসা’। লেখার আমন্ত্রণ রইলো।