একখান ছোটো পদ
তুমি দিলা লাল গনগনা আঙরা।
আমি ভাবি… বনেলা ফুল…
মধুতে মিশাল তোমার স্তনের রঙ।
এগানা আঙ্গুলে রক্ত জাগলো
রক্তপুণ্যির চান।
ঠোঁটে তুলে দেখি চৈতের চেয়েও খরা।
এখনো তিরাস!
ঘোর নিরালা হু হু হাওয়ার বান!
একদিনের সঙ্গী এক মারফতী ফকিররে
আমি যদি বুঝি আর নিজ জবানে কই ’গাছ’
তবে গাছ আছে, না কইলে গায়েব;
আমার জগতে সেই গাছ নাই।
এই যে দেখেন কতো রঙচঙা দুনিয়া
কে বুঝলো নাই কি-বা আছে?
সে তো আমার রুহু আর আমার জবান।
আমি না দেখলেই নাই।
ফকফকা সামনে পিছনে!
আমার ভাবনা আর মুখের মধ্যে আপনার জয়-ক্ষয়,
অদল বদল আমার ইচ্ছার লেঙ্গুরে।
যতোদিন বোধে ছুঁইয়া জাহের না করি
ততোদিন আছে বটে গায়েবানা বসতি,
তবে আসলেতে নাই।
আমার দেলের ভেতর আপনার জন্মমৃত্যু হাঁটা চলাফেরা
জাহের আমার মধ্যে, বাতেনও আমার।
চল্লিশ কাঁইকের মধ্যে আগুপিছু করি
আমি চিনি পিছটানে মানুষ।
অথচ আমার চাইরোদিক আগ বাড়ায়া থাকে।
আমি শ্যাওড়াতলার জোছনায় ‘সাপ নাকি দড়ি’ এই দ্ব›েদ্ব পইড়া
আগাইতে পিছাইতে শুনি সমাজ-নমাজ আগায়
আগায় দেশ-জাত মানুষ আর মানুষের বেহুদা তিরাস।
আমার মারফতী মামাজান বলেছিলেন
শূন্যে যার শেষ পাও সে ক্যামনে আগায়?
তারে আগানো কই কোন মাপে, কোন জোলা জ্ঞানে?
এই কথা বুঝলো যে সেয়ানে
তারে লয়্যা আমি খেলানেলা করি
আর আগানো পিছানো লয়্যা কথা কাটাকাটি করি।
এই ফাঁকে সকলই আগায় বইলা ডাক ছাড়ে।
খালি একলা আমি নরাখালির পাড়ে মাপ মতো চল্লিশ কদম হাঁটি
আর চল্লিশ কদম ফিরত যাই।
এইমতো চল্লিশ কাঁইকের মধ্যে আমি আগুপিছু
জীবন যাপন করি চল্লিশ কাঁইকের।
তোমার কাছে বলা
তোমার কথা ছিলো আষাইঢ়্যা মেঘ হয়্যা আসার
খটখটা মাটি আর আসমান একাকার করে।
রক্ত থেকে বিন্দু বিন্দু মধু তুলে এই মুক্তা
গড়েছি যখন আমার প্রতিদিনের শব্দে
তিরাসেও ছিলো নিশার চানপশর
আর সবখানে মেঘের গোপন ছায়া
মেঘ দে পানি দে গানের আবেশ।
অথচ বাতাস ভিজেনি।
দেখি তুমি স্থির হয়ে আছো নিদানের শাদা মেঘ-ছায়া।
অথচ তোমার কথা ছিলো জলছাপ ভাইঙ্গা
রক্তের জোয়ারে আসার।
দুঃখ গর্ভে কথক গাছের জন্ম
মরে যাওয়া পথের নিশানা ফের মর্মভেদী হলো এই চৈতরাতে।
এখন চোখ খুললেই গলে পড়া জানালার পৃথিবী
দিনের উর থেকে আর সব দিনের বার হয়্যা আসার কাহিনী
যে-প্রস্থান উৎকীর্ণ পাথরের কোষে কোষে
প্রতœতাত্তি¡ক বোধ তাকে ঢাকে প্রাচীন চাঁদনীতে।
আর স্কুল-ফেরা পায়ের ছাপ খুঁড়ে তুলতে গিয়ে দেখি
আদিগন্ত ছিঁড়ে আসে নাড়ি;
অবক্ষেপ মর্মন্তুদ ধূলিকণা।
না-কি হাওয়ার কারসাজি?
বুঝি অর্ধেক ভুলে যাওয়া একটি বাউলা গান
আৎকা বেজেছে স্নায়ুমূলে।
একে কি বলবো ‘বেদনা’… যে ঘর জুড়ে চৈত্রের বীজময় হাওয়া।
ভাবের ঘরে ফেনিয়ে উঠছে তার অত্যুজ্জ্বল ফল।
আজ এই উৎসমুখে জন্মাবে যে আচানক কথক গাছ
সে আমাকে কোঁচে গেঁথে রেখে
কেমন নিঃশব্দ পায়ে ঘরময় ঘুরেই চলেছে।
তোমার পক্ষী জন্মে
আজন্ম তিরাসের বুকেই জেগেছিলো পতনের গান।
আয়নার ভাঁজে ভাঁজে এতো নিরালা মউত! আমি একজন্ম আয়না দেখি নাই।
এতো তবু তীব্র কেন্দ্রচ্যুতির টান ছিলো
তাই মাতৃভুমি ছিঁড়ে গেছে স্বপ্নের আয়াস।
এখন স্বীকারোক্তির দিনে পক্ষীমুখে আদি কথা গাই শিল্পোচ্ছলে।
স্রোত তুমি অলক্ষ্যেই ঘুরে গেছো জনপদে।
সে গোপন খোলস-বদল রাষ্ট্র হয় বহুলগ্ন পরে।
এখন আর কারে কই নির্জন পক্ষী মাতা
একদা এসেছো ছেঁড়ে পরবাসে।
কিছুকাল আগুনে আগুন পুড়িয়ে
আমারও পদব্রজে নিজস্ব ফেরার কাহিনী।
ক্ষত-তৃষ্ণা মাংসতলে রেখে
মনপুড়া পথকথা নিজেই বয়ান করি নিজের কাছে।
আর খরতাপে ভাবি তোমার পক্ষী জন্মে আমিও উড়তে চেয়েছি
অথচ পাখই ছিলো না আমার।
ফুল-পাখি-ঘাসহীন একটা গ্রামে
এইখানে আইজকাল যেসব কচি কলাপাতা দুর্বা গজায়
তারা জানে না সেই বিদায়ের কথা।
দুর্বার কাঁথায় কোন্ নিরাকের মউত?
চোখ হতে গড়্যায়া গোপনে নামা এই নোনাপানি…
গড়্যায়া স্বপ্নের গাঙ্গে পড়ার আগেই
তোমার দুই হাত ভর্তি রঙচঙা পাথর?
পাথরে কি সুখ থাকে, ঝোপঝাড় গজায়,
সেই ঝোপে ফুল ফুটে, পাখি গান গায়?
এইখানে একদা না-কি সবুজ ঝোপঝাড়ে
ছোটো ছোটে পাখিরা ঝাপিয়ে নামতো।
আমি এইজন্মে আর কোনোদিন সেইসব পাখি
কিংবা ফুলদের নাম জানতে পারবো না।
আমি ঘাসহীন, ফুলহীন পাখিহীন একট গ্রামে বসে তোমার কথা ভাবি।
তুমি সঙ্গে এলেও পারতে…
এই গ্রাম অনন্ত ফুল-পাখি-শস্যময় হতো।
নিরাকের শব্দগুলো
হয়তো বা কেউ ছিলো, যেমন ছায়ার থাকা অগোচরে।
কেননা এখন কেউ না-থাকার মতো বুঝি লাগে
এই রাত-জাগা বোধ। যেন শ্লেটে যতেœ লেখা নাম
আঙ্গুলে মুছে গিয়েও বিবর্ণ রেখায় কিছু জাগে।
ঘরে নানা অনুষঙ্গ… জানালায় চারকোণা আসমান
আসমান ছুঁয়ে দিলে বাওয়ে ভাসায় চোখজোড়া।
নিঃশ্বাসের স্মৃতি নাই, স্পেসে তবু উষ্ণতার ঢেউ।
বুঝি লঘু প্রণোদনা, ভেতরে ভেতরে ঘরপোড়া।
এই ভঙ্গি ক্ষরোজ্জ্বল! তার গর্ভে আচানক ঘটনারা ঘটে গেলে
জনহীন কবির আঙ্গুল বেয়ে জোছনা নামে
সর্বত্র রয়েছে ছায়া, স্মৃতিঘরেও উঠছে বুদ্বুদ।
তাই ডর-অঘুমা বোধ গড়ায় কি না স্বপ্ন সংক্রামে।
তবে কি আদতে শূন্য সত্য নয়, শুধু আলো ও আঁধারী?!
দ্বিধাদ্ব›েদ্ব দ্বার খুলে দেখি বুদ্ধনগরে খা খা বাওর!
পরিসর আসবাব রাজি শূন্যতায় ভরে দিলো
কোত্থেকে ঝাঁপিয়ে আসা মেঘমন্দ্র ভোরের পসর।