004745
Total Users : 4745
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

সাংস্কৃতিক আধিপত্য, উত্তর-উপনিবেশবাদ ও আমাদের আত্ম-পরিচয়ের প্রসঙ্গ

এ কালে এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে পশ্চিমা আধিপত্য খুবই বলশালি ও সক্রিয় এক বাস্তবতা। বিভিন্ন জাতি/রাষ্ট্রের মধ্যে হানাহানি, স্বৈরাচারি ও পারিবারিক দুঃশাসন, বিশাল শ্রেণি বৈষম্য, গোষ্ঠি ও ধর্মের মারামারি, কাটাকাটি, সাধারণ মানুষের চরম গরিবানা, সমাজের স্তরে স্তরে শোষণ-নির্যাতন টিকে থাকার সাথেও ঐ আধিপত্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। এর প্রভাবশালি চেহারাটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। অনেক দেশের ঘরোয়া রাজনীতির ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি মাতব্বরি অথবা জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে পরামর্শ ও চাপ প্রয়োগ এখন খোলামেলা ব্যাপার। আবার আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, পশ্চিমের বহুজাতিক কোম্পানি এবং দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর মাধ্যমেও নানা কিসিমের সংস্কার, প্রকল্প ও নীতিমালা এবং পরিস্থিতি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে অর্থনীতিতে। এগুলো আমাদের সবার জানা। বিভিন্ন সংঘ ও সমাবেশ থেকে তার প্রতিবাদও হচ্ছে। এ সত্তে¡ও আধিপত্যের সাংস্কৃতিক রূপটাই সবচেয়ে স্পষ্ট ও জোরদার। তা সরাসরি পৌঁছে যায় ভোক্তার কাছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের তুলনায় সাংস্কৃতিক আধিপত্য অনেক প্রকাশ্য একটা ব্যাপার, আর তা ছড়াচ্ছেও ত্বরিতে, বাধাহীনভাবে। সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারই হল হেজেমনি।
ইতালির মার্কসবাদি বুদ্ধিজীবী আন্তোনিও গ্রামসি মনে করতেন (পশ্চিমের) কোনো সমাজে ঠিক একধরনের সংস্কৃতি থাকে না, পাশাপাশি অন্যান্য রূপও থাকে। কিন্তু কোনো একটি রূপ হয় প্রভাবশালি তা প্রভাবিত করে অন্যগুলোকে, বিশেষ করে নিম্নবর্গের সংস্কৃতিকে। এক সংস্কৃতি কর্তৃক অন্য সংস্কৃতির ওপর এইরকম প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারটিকে হেজেমনি বলেন তিনি। পশ্চিমের শিল্পায়িত সমাজকে বোঝার জন্য হেজেমনি একটি জরুরি ধারণা। প্রভাবশালি গোষ্ঠিটি নিম্নবর্গের নিকট থেকে স্বীকৃতি পায় হেজেমনির কারণে। এই স্বীকৃতির বিষয়টাও বোঝা দরকার। বিশ্বব্যাপি মার্কিন আধিপত্য ক্ষমতার পাশাপাশি এ-ও চায় যে, সংশ্লিষ্ট জনগণ তাদের উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করুক, করুক শ্রদ্ধাভক্তিও। কথা হচ্ছে, আজকের স্যাটেলাইট টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য প্রকৌশলগত সুবিধার বদৌলতে ঐ হেজেমনি বা সাংস্কৃতিক আধিপত্য যেন রূপকথার রাজপুরির এক রাক্ষস, যা একে একে গিলে চলেছে আমাদের সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বভাবধর্ম, আচার-প্রথা-এক কথায় আমাদের আত্ম-পরিচয়। তা আবার প্রভাবিত করছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে। এখনো অনেক পণ্ডিত আছেন, প্রাতিষ্ঠানিক লেখক-গবেষক আছেন যারা কেবল নন্দনতাত্তি¡ক দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কৃতির বিচার করেই তুষ্ট। আমি নন্দনতাত্তি¡ক বিচারের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু তার আগে বিচার্য কাজটির আর্থ-রাজনৈতিক পটভূমি ও লক্ষ নিয়ে খানিকটা ভেবে দেখতে চাই। বুঝতে চাই কোনো একটি সংস্কৃতিচর্চা ভোক্তা আমার মধ্যে কোন প্রবণতার জন্ম দেয়, সেই প্রবণতার আর্থ ও রাজনৈতিক গুরুত্ব কিরূপ। এবং তা আমার আত্মপরিচয়ের সাথে সংঘাতময় না সহযোগি।
একেবারে কাঁচা উপাত্তের পর্যায়ে গিয়ে কয়টা কথা বলা যেতে পারে। যেমন, ইউরোপ-আমেরিকা ফেরত কিছু পয়সাঅলা, বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও যৌন-উস্কানিমূলক পত্রপত্রিকা ও বিজ্ঞাপন যদি জিন্সকে জনপ্রিয় করে থাকে, তাহলে জানতে হবে ঐ জনপ্রিয়তার পরিণতি কি? এর ফলে যদি প্রতি বছর শত কোটি ডলারের জিন্স আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে তাহলে ঐসব শিল্পকর্ম উপভোগ এবং আলোচনার করার সময় এই ক্ষতির বিষয়টাকেই প্রথমে উলে­খ করতে হবে। এবং আর্থিক ক্ষতির তুলনায় আরো বড় কিছু পাওয়ার নিশ্চয়তা না থাকলে আমি ঐ সব শিল্পকর্ম প্রচারের বিরুদ্ধে, ঐ সব সিনেমা, পত্রপত্রিকা ও বিজ্ঞাপন প্রচারের বিপক্ষে। অন্তত ঐ কাল পর্যন্ত, যখন সিনেমা-পত্রপত্রিকা-বিজ্ঞাপনের গূঢ়-গভীর সম্পর্ক। হেজেমনি বা সাংস্কৃতিক আধিপত্য বলতে আমরা বুঝি কেবল এক সংস্কৃতি কর্তৃক অন্য সংস্কৃতির ওপর প্রাধান্য। প্রাথমিকভাবে তা সত্যি। কিন্তু এখানেই হেজেমনি শেষ হয়ে যায় না। প্রভাব বিস্তারের গোটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক আধিপত্য সমাজের তলা পর্যন্ত স্পর্শ করে এবং চুঁইয়ে চুঁইয়ে ভিজিয়ে রাখে সমাজের প্রতিটি স্তর। যেমন রেমন্ড উইলিয়ামস মূল কাঠামো-উপরিকাঠামোর বেড়া ডিঙ্গিয়ে গিয়ে উপলব্ধি করেন হেজেমনি বা সাংস্কৃতিক আধিপত্য সমাজের অধিকাংশ মানুষের বাস্তবতাবোধকে প্রভাবিত করে। এবং সমাজের অনেক মানুষের পক্ষেই সেই বাস্তবতাবোধের সীমানা পার হয়ে যাওয়া কঠিন। (উইলিয়ামস, ১৯৮২; ৩৮)। এর জন্যই তা সা¤প্রতিক মার্কিন আগ্রাসনে এক অব্যর্থ অস্ত্রের মতো। এটি প্রভাবিত করে বাস্তবতাবোধ ও মূল্যবোধ। সেই প্রভাব অবশ্যই আধিপত্যশিল সংস্কৃতির জনগোষ্ঠির চিন্তাভাবনার পক্ষের ব্যাপার। তা বাস্তবতা, এমনকি মানুষ ও তার তৎপরতার জগত ব্যাখ্যা করার প্রক্রিয়াটিকেও স্পর্শ করে। কেবল এভাবে দেখলে বুঝতে পারব পশ্চিমের সাংস্কৃতিক আধিপত্য কি করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের সহায়ক ভূমিকা পালন করে, কখনো কখনো তার জন্য প্রয়োজনিয় পথ তৈরি করে এবং ওগুলো টিকে থাকার ব্যাপারেও সহায়তা করে।
এখনকার পৃথিবীতে ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য টিকে থাকার পেছনে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ভূমিকা যথেষ্ট শক্তিশালি। এডওয়ার্ড সাঈদ যেমন বলেছেন, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে মূলত অর্থনৈতিক সে কথা মানি, কিন্তু তা চলছে আমেরিকা সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক মত ও মতাদর্শের ওপর ভর দিয়ে, এগুলোর সাথে পা মিলিয়ে।’ (সাঈদ, ১৯৯৪, ৩৫০)।
এ কথার অর্থ আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশিল, এগুলো একটা আরেকটার পরিপূরকও। পশ্চিমের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তার সাংস্কৃতিক রূপটাও জানা দরকার।
সাদামাটা কথায় সাংস্কৃতিক আধিপত্য হল কোনো একটি সংস্কৃতিতে ভিন্ন সংস্কৃতির চিহ্ন ও চর্চাগুলো জায়গা করে নেয়া। এ ক্ষেত্রে যে সংস্কৃতি জায়গা নিচ্ছে তা হল আধিপত্যশিল সংস্কৃতি। এইসব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, আচার, চর্চা ও চিহ্নসমূহ রপ্ত ও জমা হয় বহু যুগের চর্চা ও অভ্যাসের ফলে। এবং এর সাথে জড়িয়ে থাকে ঐ জনগোষ্ঠির পরিবেশ, আবহাওয়াসহ বেশ কিছু পরিস্থিতি। অন্যদিকে, তাদের অর্থনৈতিক জীবন-সমাজবিন্যাসও অনেকাংশে ঐসব পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশিল ছিল শিল্পায়নের যুগের আগে পর্যন্ত। এই সূত্রে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক অভ্যাস তার অর্থনৈতিক স্বভাবকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। সাংস্কৃতিক অভ্যাসের বদল ঘটলে অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়বেই। এককালে এ দেশের মেয়েদের প্রসাধনে ব্যবহার্য হলুদ, চন্দন ইত্যাদি এদেশেই উৎপন্ন হত। এর জন্য অন্য কোনো দেশকে অর্থ দিতে হত না। যখন দেশিয় প্রসাধনের বদলে বিদেশি কেমিক্যাল প্রসাধনের ব্যবহার শুরু হল তখন থেকে আমাদের জাতিয় ব্যয়ের আরেকটা খাত বাড়ল; এখন তা বিরাট অংকের জাতিয় ব্যয়ের জায়গা।
এইসব নমুনা তুলে ধরে যা বলতে চাই তা হচ্ছে, পশ্চিমের আধিপত্যের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা বলা হচ্ছে, তার সাথে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের কোনো ফারাক নেই। বরং লড়াইয়ের তিনটা ময়দানকেই আমি জরুরি মনে করি। এক. রাজনৈতিক, দুই. অর্থনৈতিক, তিন. সাংস্কৃতিক। এবং তিন জায়গায় লড়তে হবে একসাথে। না হলে কোনো একটায় আমাদের দুর্বল অবস্থান প্রভাবিত করবে অন্য জায়গাটাকে।
বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক ময়দান সবচেয়ে অরক্ষিত, বলা যায় এখনো লড়াই শুরুই হয়নি। সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, সিনেমা, নাটক, পোশাক-পরিচ্ছদ তথা ফ্যাশন, খাওয়া-দাওয়া, পারস্পরিক ভাববিনিময় ও আচারআচরণ-এক কথায় বর্ণনা, যোগাযোগ ও প্রতিনিধিত্বমুখি শিল্পকলার সব শাখাতেই পশ্চিমা সংস্কৃতির চিহ্নগুলো দিন দিন জোরাল হচ্ছে। সা¤প্রতিককালের সংযোজন স্যাটেলাইট টেলিভিশন এক্ষেত্রে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে, এর মধ্য দিয়ে বলবান হচ্ছে পশ্চিম সম্পর্কে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাও। এবং সেই সাথে বাড়ছে পশ্চিমের ওপর আমাদের অর্থনৈতিক নির্ভরশিলতাও।
সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়তে হলে আগে প্রয়োজন দাঁড়ানোর একটা জায়গা-যা একান্তই নিজস্ব। এখানেই চলে আসে আত্ম-পরিচয়ের প্রসঙ্গ।
আত্মপরিচয় হচ্ছে নিজের সম্পর্কে একটি জনগোষ্ঠি-নির্ভর ঐক্যবদ্ধ ধারণা। মধ্যযুগের পর জনগোষ্ঠি সম্পর্কিত ধারণাটি জাতির ধারণায় পরিণত হয়েছে। ঐ জনগোষ্ঠির বা জাতির যা কিছু অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বের তার উত্তরাধিকার নিয়ে ব্যক্তি আমি’র যে পরিচয় তাই আত্মপরিচয়। অতএব আত্ম-পরিচয়ের মূল আশ্রয় সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য। সাংস্কৃতিক আধিপত্য আত্ম-পরিচয়ের এই বোধকে কেটে চলে। সংস্কৃতির ময়দানে সফলভাবে লড়ার জন্য দরকার আত্ম-পরিচয়ের বোধ; এবং সেই বোধে কোনো হীনমন্যতা না থাকা জরুরি।
এ প্রসঙ্গে আত্ম-পরিচয়ের বিপরিতে ‘আন’ বা ‘আদার’-এর পরিচয়ের বা নির্মাণের প্রসঙ্গটি এসেই যায়। এডওয়ার্ড সাঈদ আমাদের সতর্ক করে দিতে চেয়েছেন যে, আত্ম-পরিচয় সম্পর্কে শ্রেষ্ঠতার বোধ ‘আন’ বা ‘আদার’কে নিকৃষ্ট ভাবতে উস্কানি দেয়। যেমন দেখা যায় পশ্চিমা জাতিগুলোর সাংস্কৃতিক অহংকারের ব্যাপারে। বহুকাল আগে এই ভারতিয় উপমহাদেশে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে অন্যদেরকে নিকৃষ্ট করার ব্যাপারটাও ভয়াবহভাবে ঘটে গেছে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও অন্যকে নিকৃষ্ট মনে করার প্রক্রিয়া ও পরিণতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সাঈদ অরিয়েন্টালিজম এবং কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজম গ্রন্থে।
প্রায় দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসন নির্যাতনের ফলে আমাদের উপনিবেশ-পূর্ব আত্ম-পরিচয় নানাভাবে বেঁকেচুরে গেছে, মুছে গেছে অথবা গৌণ হয়ে আছে এর নানা বৈশিষ্ট্য। ঔপনিবেশিক জ্ঞান ও সংস্কৃতি আমাদের ভাব ও সংস্কৃতির বিভিন্ন চিহ্ন হটিয়ে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে।
আত্ম-পরিচয় অর্জন বা উপলব্ধির প্রক্রিয়ায় তুল্য পটভূমিতে একটি জনগোষ্ঠি ও পরিপার্শ্ব থাকবে, তাই অতীত ও ঐতিহ্যও থাকবে। মধ্যযুগের শেষে, আমাদের এখানে জনগোষ্ঠি সম্পর্কিত ধারণা জাতির ধারণায় বিস্তৃত হয়। ঐ জনগোষ্ঠি বা জাতির যা কিছু অহংকারের তার সকল কিছু নিয়ে মানবিক প্রতিমূর্তি তৈরি হয়। তার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়াটাই আত্ম-পরিচয় অর্জনের প্রথম শর্ত। আত্ম-পরিচয় যেহেতু কেবল ব্যক্তিগত নয়, তাই তা অর্জন করতে হয় এবং স্বাভাবিক বা অন্তত স্বাভাবিক মনে হয় তেমন প্রক্রিয়ায় অর্জন করতে হয়। হোমি ভাবা বিষয়টিকে চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন-‘আত্ম-পরিচয় অর্জন হল আত্ম-পরিচয়ের প্রতিরূপ নির্মাণ এবং সেই প্রতিরূপ গ্রহণের জন্য ব্যক্তির (অনুরূপ) রূপান্তর।’ (ভাবা, ৯৪,৪৫)। অর্থাৎ এটি কোনোমতেই কৃত্রিম বা বাইরের জিনিস নয়। বসবাসের পরিপার্শ্ব ও জনগোষ্ঠির সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে বৈরিতা বা একাত্মতাবোধের মধ্য দিয়েই তা ঘটে। তাই আত্ম-পরিচয়ের উৎস সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্যিক-ঐতিহাসিক এবং এগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের সূত্রে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোও এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। উপনিবেশের সূচনা থেকে আমাদের ভাব ও সাংস্কৃতিক পরিসরে জায়গা করে নিতে থাকে পশ্চিমের ঔপনিবেশিক জ্ঞান ও সংস্কৃতি। সেই সাথে বাঙালির আত্ম-পরিচয়ও রদবদল হচ্ছিল।
দু’শো বছর ধরে চলতে থাকা এই প্রক্রিয়ায় যে আত্ম-পরিচয়ের সাথে আমরা আজ একাত্ম তা উপনিবেশি জ্ঞানভাষ্য ও সংস্কৃতির প্রভাব থেকেই উদ্ভূত। এই আত্ম-পরিচয় হীনমন্যতায় দূষিত, ‘পশ্চিমারা উন্নত আমরা অনুন্নত’-এমন সব ধারণায় বিকৃত। এই আত্ম-পরিচয় পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সা¤প্রতিক ব্যাপক আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। কাজেই আমাদের আত্ম-পরিচয়ের মধ্যে উপনিবেশি প্রভাবগুলো চিহ্নিত হওয়া দরকার। সেই সাথে দরকার উপনিবেশ-পূর্ব বাঙালি আত্ম-পরিচয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে বের করা যা আমাদের প্রকৃত আত্ম-পরিচয়ের ভিত্তি-কাঠামো, লড়াইয়ের ময়দানে সমাবেশের জায়গা।
এই যে আকাক্সক্ষা, পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়ার ও আত্ম-পরিচয় অর্জনের বাসনা-সে বাসনা উত্তর-উপনিবেশি মনের বাসনা। উত্তর-উপনিবেশবাদ উপনিবেশি জ্ঞানভাষ্য ও সংস্কৃতির প্রভাবগুলো চিহ্নিত ও দূর করার মধ্য দিয়েই উপনিবেশ-পূর্ব ভাব ও সংস্কৃতির জগত পুনঃনির্মাণে প্ররোচনা দেয়। পশ্চিমা আধিপত্যবিরোধি লড়াইয়ে উত্তর-উপনিবেশিকতা বা উত্তর-উপনিবেশবাদ অত্যন্ত শক্তিশালি ও জরুরি এক যোগাল।

২.
উত্তর-উপনিবেশবাদ হানা দেয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যের গোড়ায় ঔপনিবেশিক জ্ঞান ও সংস্কৃতিতে। এটি উপনিবেশের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এবং উপনিবেশের প্রভাব নির্বীজ করার লক্ষ্যে উদ্ভূত সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা ও আন্দোলন। উপনিবেশি শাসকদের উদ্যোগ-সমর্থনে পরিচালিত স্বার্থসংশ্লিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা ও জ্ঞনচর্চার কারণে বিভিন্ন দেশ ও জাতির ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতা, ভাবনার জগৎ ও তার চর্চার ক্ষেত্রে যেসব নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত ও দূর এবং আধিপত্যমুক্ত জ্ঞানচর্চার পথ খুলে দেওয়ার কিছু তাত্তি¡ক প্রণোদনা ও উপায় এবং একরকম আন্দোলন বলা যেতে পারে উত্তর-উপনিবেশবাদকে। চরিত্রের দিক থেকে এটি একটি পাল্টা জ্ঞানভাষ্য (Counter Discourse)।
উত্তর-উপনিবেশবাদি তত্তে¡র কাজের পরিধি কেবল উপনিবেশি প্রভাবের মধ্যে সীমিত নয়। এখন বিশ্বায়নের নামে আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মধ্য দিয়ে যে নয়া-উপনিবেশায়ন (Neo-colonization) চলছে পৃথিবীজুড়ে, এ-তত্ত¡ তাকেও চর্চার অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। উত্তর-উপনিবেশি তাত্তি¡কদের মধ্যে ফ্রানজ ফানোন-এর লেখায় নয়া-উপনিবেশবাদ বিকাশের ব্যাপারে গূঢ় ইংগিতও আছে। উপনিবেশি প্রভাব নয়া-উপনিবেশবাদ বিস্তারের সহায়ক এক পরিস্থিতি।
কাজের ক্ষেত্র ও উদ্দেশ্য বিচার করলে উত্তর-উপনিবেশবাদের সীমানা কেবল বাড়তেই থাকবে। উপনিবেশি শিক্ষা ও জ্ঞান সংশ্লিষ্ট মানুষদের সকল বিষয়েই প্রভাব ফেলেছে, তার কিছুটা সুফলপ্রদও ছিল হয়ত। তবে বেশির ভাগই কোনো-না-কোনোভাবে নেতিবাচক। তাহলে সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, সমাজবিদ্যা, ইতিহাস, ধর্মচর্চা, অর্থনীতি, শিল্পকলাসহ বহু বিষয়ই তার আওতার মধ্যে পড়ে।
এক অর্থে এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদকে (১৯৩৫-২০০৩) উত্তর-উপনিবেশবাদের তাত্তি¡ক পীর বলা যেতে পারে, বিশেষত তাঁর অরিয়েন্টালিজম গ্রন্থের কারণে। এ-গ্রন্থে সাঈদ পশ্চিমের বহু গুরুত্বপূর্ণ রচনা ঘেঁটে দেখান কিভাবে উপনিবেশি জ্ঞানচর্চা উপনিবেশিতের সংস্কৃতি, অভিজ্ঞতা, বাস্তবতাকে বিকৃত করে, এমনকি মুছে ফেলে; আর এর মধ্য দিয়েই উপনিবেশিতদের চিহ্নিত করে নিকৃষ্ট ‘আন’রূপে। এই যে নিকৃষ্ট, অসভ্য, নিয়ন্ত্রণযোগ্য ‘আন’রূপে চিত্রিত করার প্রবণতা, একসময়ে তাই পরিণত হয় জ্ঞানচর্চার ধরনে। ক্রমে এই জ্ঞান সংক্রামক পদ্ধতিতে সৃষ্টি করা হয় আরো জ্ঞান ও ভবিষ্যত চর্চার ধারা। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনিয় প্ররোচনাও নিহিত ছিল এর মধ্যে। এটিই উত্তর-উপনিবেশি তত্তে¡র গোড়ার কথা। উপনিবেশকেরা কেবল উপনিবেশি জ্ঞানভাষ্যের মূল্য আরোপ করেই বসে থাকেনি, নিজেদের আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রচার করে স্থানিয়দের উদ্বুদ্ধ করেছে, যেন এরাও ইউরোপিয়দের মতো হওয়ার চেষ্টা করে। এটিই মানুষের বিশ্বজনীনতার (univesality) ধারণা। অর্থাৎ পশ্চিমা জ্ঞানভাষ্য মানুষের এমন একটি বিশ্বজনীন রূপ নির্মাণ ও প্রচার করেছে, যা আসলে ইউরোপিয় আদর্শের প্রতিবিম্ব। আত্মপরিচয় নিয়ে হীনমন্যতার শিকার স্থানিয়রা স্বাভাবিকভাবেই ওই আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার আকাক্সক্ষা লালন করে। উপনিবেশের জ্ঞানজগতে এইসব উপনিবেশি বিন্যাস নিষ্ক্রিয় করা (বা উলটে দেওয়া) উত্তর-উপনিবেশি অধ্যয়নের লক্ষ্য। উপনিবেশি প্রভাবের ধরন এবং সেসব নিষ্ক্রিয় করার কিছু পদ্ধতিগত দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় সাঈদের অরিয়েন্টালিজম ও কালচার অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম গ্রন্থে।
উত্তর-উপনিবেশি তত্ত¡ নিয়ে কথাবার্তা শুরু হওয়ার পর তাত্তি¡ক ও চর্চাকারিদের কাছে ফ্রানজ ফানোন (১৯২৫-১৯৬১) এবং আরো দু-একজন অগ্রজ লেখক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। উপনিবেশের কারণে স্থানিয় জনগোষ্ঠির মনোজাগতিক ক্ষয়ক্ষতি এবং তা কাটিয়ে ওঠার প্রসঙ্গ নিয়ে ফানোন অনেক জরুরি কথা বলেছেন। উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতি বিশ্লেষণেও তাঁর চিন্তাধারা বেশ কার্যকর। ফানোন লিখেছেন পঞ্চাশ-ষাটের দশকে।
ফানোন এর চিন্তাভাবনায় সমৃদ্ধ ও উদ্দিপ্ত হয়েছেন সাঈদ। বিভিন্ন উপলক্ষে সে ইংগিতও রেখেছেন। উপনিবেশের রাজনৈতিক পরিণতির ওপর জোর দিয়েছেন ফানোন, প্রসঙ্গক্রমে এসেছে উপনিবেশিতের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মনস্তত্তে¡র কথা। আর সাঈদ সাংস্কৃতিক অধ্যয়নকে অবলম্বন করেন সাহিত্যে। উপনিবেশকের সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার সক্রিয় আধিপত্যের ভেতর দিয়ে উপনিবেশিতের সংস্কৃতি ও বাস্তবতা কিভাবে বিকৃত হয়, তা সনাক্ত করেন তিনি। প্রাচ্য নিকৃষ্ট এবং পশ্চিম উৎকৃষ্ট এই মনোভাবের ওপর ভর করে কিভাবে পশ্চিমে নানা রচনা প্রকাশিত হয় এবং ক্রমে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখার প্রচারক শক্তি জোগায় পশ্চিমের রাজনীতিবিদদের মনে তার একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় অরিয়েন্টালিজম গ্রন্থে। অরিয়েন্টালিজম উপনিবেশবাদ কর্তৃক উপনিবেশিতের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতাকে বিকৃত করার জ্ঞানতাত্তি¡ক প্রক্রিয়ারও এক অসামান্য দলিল।
কেনিয় লেখক নাগুগি ওয়া থিয়োঙ্গার উত্তর-উপনিবেশি কৌশল নিয়ে সাঈদ আলোচনা করেছেন কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম গ্রন্থে। নাগুগি উপনিবেশকের ভাষা ও সংস্কৃতিকেও বর্জনের পক্ষপাতি। বি-উপনিবেশায়নের কার্যকর উপায়গুলো খুঁজে বের করার প্রক্রিয়ায় তাঁর চিন্তাভাবনাও বিশেষ প্রভাবসম্পাতি। তাঁর ডিকলোনাইজিং দি মাইন্ড (১৯৮৬) এ বিষয়ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ রচনা। নাগুগি মনে করেন, কেবল উপনিবেশকের সংস্কৃতিকে বর্জন করলেই চলবে না। উপনিবেশকের সংস্কৃতিকে প্রতিরোধের সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভিত্তিও গড়ে তুলতে হবে। স্থানিয় ভাষা পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনিয়তাকে তর্কের ঊর্ধ্বে মনে করেন তিনি। ভাষাকে তিনি চিহ্নিত করেন উপনিবেশি জ্ঞানভাষ্যের সন্ত্রাসের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে, কেননা ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আত্ম-পরিচয়ের বিষয়টিও।

 

উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতি
পশ্চিমের সাংস্কৃতিক আধিপত্য এমন নির্বিঘ্নে চলতে থাকার বড় কারণ ঔপনিবেশিক শাসন এর জন্য প্রয়োজনিয় ভূমি (ক্ষেত্র) বানিয়ে দিয়েছে। একেই বলা হচ্ছে উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতি। উত্তর-উপনিবেশবাদি তৎপরতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ হল উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতি সনাক্ত করা, এক অর্থে তা কাজের প্রথম ধাপও। স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরও রাষ্ট্রিয় কাঠামো থেকে শুরু করে জনজীবন পর্যন্ত উপনিবেশি সংস্কৃতির প্রভাব অনেকখানি অক্ষুন্ন থেকে যায়। উপনিবেশি বিন্যাসের প্রভাবের মধ্যে আবর্তিত এ-অবস্থাকেই বলা হচ্ছে উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতি।
ফ্রানজ ফানোন-এর লেখালেখির একটা বড় অংশ জুড়ে আছে উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতির প্রসঙ্গ। সাইকো-অ্যানালিস্ট ফানোন বলেন, উপনিবেশি শাসনের কারণে উপনিবেশক এবং উপনিবেশিত উভয়ের মধ্যেই মনস্তাত্তি¡ক পরিবর্তন আসে। উপনিবেশকদের সচেতন চেষ্টায় স্থানিয়দের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ক্ষয় হতে হতে একসময় বিলীন অথবা মরে যায়। ‘উপনিবেশিতের সাংস্কৃতিক শিকড়ের মৃত্যু ও সমাধি তার মনে জন্ম দেয় হীনমন্যতাবোধের’ (ফানোন ১৯৬৭; ১৮)। ক্যারিবিয় অঞ্চলে কার্নিভালের সময়ে কাল দাসেরা সাদা মুখোশ ব্যবহারের অনুমতি পেত এবং তা ব্যবহার করে তাদের সাদা প্রভুদের ক্যারিকেচার হয়ে উঠত। ফানোন বলেন, সাদা মুখোশ পরে কাল দাসদের সাদা হয়ে ওঠার এই প্রবণতা অধিকাংশ কাল মানুষের মধ্যে এখনো প্রবল। তারা কেবলই তাদের সাদা প্রভুদের মতো হয়ে উঠতে চায়। এটি হল ঔপনিবেশিক প্রভাবে নুয়ে পড়া মনের একটা ধরন। এজন্যই সৌন্দর্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফর্সা হওয়ার প্রায়-অলঙ্ঘনিয় শর্ত। পৃথিবীর সকল কাল মানুষ আজও ফর্সা হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ওষুধ-রূপচর্চা আর বিজ্ঞাপনের পেছনে ব্যয় হচ্ছে শত শত কোটি ডলার।
ফানোন উপনিবেশিতের মনের এ পতনকে উপনিবেশের ফল হিসেবে চিহ্নিত করেন। উপনিবেশিতের মনে উপনিবেশি সংস্কৃতির প্রতি এই যে টান ও শ্রদ্ধাবোধ এবং নিজ সংস্কৃতি নিয়ে হীনমন্যতাবোধ, যা চিহ্নিত করেন ফানোন, তা উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতির নিয়ামক-প্রবণতা। এই মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব দূরীকরণের প্রশ্নেই বি-উপনিবেশায়নের (De-colonization) প্রস্তাবনা। তাই উত্তর-উপনিবেশবাদি তত্তে¡ ফানোন-এর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতির পেছনে আছে উপনিবেশের প্রভাব। উপনিবেশের প্রভাব ও উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতির মিশ্রিত অবস্থার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এভাবে তুলে ধরা যায়:
– স্থানিয় সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বা আংশিক বিলুপ্তি। স্থানিয় সংস্কৃতির টিকে থাকা বৈশিষ্ট্যগুলোর অবমূল্যায়ন; ওগুলোকে নিকৃষ্টরূপে দেখার প্রবণতা।
ক্স আত্ম-পরিচয় সম্পর্কে উপনিবেশিতের হীনমন্যতাবোধ।
– পশ্চিম-পুব, প্রথমবিশ্ব দ্বিতীয়বিশ্ব তৃতীয়বিশ্ব ইত্যাদি আধিপত্যবাদি বিভাজনের ধারণা। স্থানিয়দের সাংস্কৃতিক, সামাজিক পরিচয় বা বৈশিষ্ট্য নির্দেশক সাধারণিকরণ ও ছাঁচ তৈরি। যেমন প্রাচ্যের মানুষ অলস, এশিয়রা নিয়তিবাদি, এশিয় সমাজব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক।
– উপনিবেশি প্রশাসকদের অনুকরণে উপনিবেশিতদের মধ্যে বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান। উপনিবেশগুলো স্বাধীন হওয়ার পর এরা সাদা প্রভুদের অনুকরণে স্থানিয় প্রভুতে পরিণত হয়। এরা প্রভুর মর্যাদা পরিপূর্ণভাবে ভোগ করার জন্য উপনিবেশি প্রভুদের অনুকরণে পশ্চিমা সংস্কৃতির চর্চা, আত্মস্থ এবং তাকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখে।
– এবং উপরে বর্ণিত কারণসমূহের ফলে প্রাক্তন উপনিবেশগুলোয় প্রচুর সংঘাতমুখি অভ্যন্তরিণ গোষ্ঠি ও অবিশ্বস্ত দলসংবলিত সমস্যাগ্রস্ত সমাজের বিকাশ। উপনিবেশের দীর্ঘকালিন প্রভাব এবং উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পশ্চিমা সকল বিছুকেই প্রত্যাখান করার প্রবণতা এবং কোথাও ধর্মিয় বা সাংস্কৃতিকসহ নানা ধরনের মৌলবাদি প্রবণতার বিস্তার, যার মূলে হয়ত থাকে উপনিবেশি অতীতের অপরিশুদ্ধতা থেকে নিজেদের সংস্কৃতিকে শুদ্ধ করার আকাক্সক্ষা।

 

বি-উপনিবেশায়ন : জায়গা ও কায়দা-কানুনের প্রসঙ্গ
বি-উপনিবেশায়ন কথাটি দুই ধাপে বিস্তৃত। প্রথমে, বি-উপনিবেশায়ন হল উপনিবেশের অবসান, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বলা যায় তার অবসান হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী এক যুগের মধ্যে। উত্তর-উপনিবেশবাদি তত্তে¡ বি-উপনিবেশায়নের পরবর্তী ধাপের অর্থই প্রাসঙ্গিক। উপনিবেশ স্বাধীন হওয়ার পর উপনিবেশক সংস্কৃতির প্রভাব বহাল থাকে স্বাধীন জনগোষ্ঠির মধ্যে, যাকে বলা হয় উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতি। এই প্রভাব কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাই হল বি-উপনিবেশায়ন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতার পর এখন আত্ম-উদ্বোধন ও প্রতিরোধ সংগ্রাম মূলত উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতির বিরুদ্ধে, সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও ভাবাধিপত্যের নিরবচ্ছিন্ন কিন্তু অসম উপস্থিতি ছুঁড়ে ফেলার জন্যে। শুরু সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশিলতায়, বোধ ও ভাবের সংগ্রামে।
উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতিতে জাতির মনস্তত্ত¡ ও চর্চায় জড়িয়ে থাকে উপনিবেশি সংস্কৃতির প্রভাব। উপনিবেশিতের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে চেতনার গভীর-গোপন গুহায় দীর্ঘকাল ধরে নিজের ছাপ আঁকতে আঁকতে তা প্রবাহিত হয়, এটিই উত্তর-উপনিবেশি পরিস্থিতির ভয়াবহ দিক। মেশানোই হোক, আর সংকর সংস্কৃতিই হোক, যুগ যুগ ধরে তাকে লালনের কারণে এর প্রতি একরকম অবচেতন মমত্ববোধ ও পক্ষপাতিত্ব দেখা দেয়; অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ব্যাপার তো আছেই। এই চোরাবালিতে আটকে যেতে পারে সাধারণ মানুষের বড় এক অংশের মনন। প্রয়োজনের সময়ে তারাই হয়ত উপনিবেশ-প্রভাবিত এ সংস্কৃতির পক্ষে সাফাই গাইতে পারেন।
উপনিবেশের সূচনা থেকে অদ্যাবধি বিকাশমান প্রতিরোধাত্মক প্রবণতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সাঈদ একটা দিকনির্দেশনার মতো বলেছেন যে, সাম্রাজ্যবাদ জাতির অতীতে যা দমন করে এসেছে, চাপা দিয়েছে, তা আবিষ্কার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বি-উপনিবেশায়নের একটা ভিত তৈরি হতে পারে, যেখানে দাঁড়িয়ে পরের পদক্ষেপগুলো নেওয়া যায় (সাঈদ ১৯৯৪; ২৫৩)। দেখা যাচ্ছে, প্রথমে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে কাজ করতে হবে, সামাজিক আচার-প্রথা-পদ্ধতির কথাও বাদ যায় না।
বি-উপনিবেশায়নের একটা পথ হল সংকর বা মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে প্রাক-ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো চিহ্নিত করা, বিকৃত অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার করা, অতঃপর ওগুলোর নিজস্ব পরিসর ও মূল্য প্রদান; উপনিবেশকের সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর তুলনায় ওগুলোকে বেশি গুরুত্বে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তা ঘটতে পারে। অর্থাৎ কেবল আলাদা আত্ম-পরিচয় নির্মাণ করলেই চলবে না, বরং সংকর আত্ম-পরিচয়কে স্বীকার করে নিয়ে সে-পটভূমিতে প্রাক-ঔপনিবেশিক উপাদানগুলোর অধিকতর উজ্জ্বল ও নিয়ামক ভূমিকা পালনের পথ তৈরি করতে হবে। ভারতিয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদি এই পথটিকে কার্যকর ভাবেন। সাঈদ মনে করেন, মিডনাইট চিলড্রেনসে এ-কাজটিই করেছেন রুশদি।
বি-উপনিবেশায়নের আরেকটা উপায়ের কথা বলেছেন সাঈদ। উপনিবেশকের সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতা এবং তার প্রভাবজনিত বিকৃতি ঝেড়ে ফেলে প্রাক-ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা ও সঞ্চয়ের ওপর ভর করে সম্পূর্ণ নতুন যাত্রাপথ তৈরি করে নেয়া। একে বলা যায় পরম উত্তর-উপনিবেশবাদ। সাঈদ আশংকা করেন, এ-ধরনের আকাক্সক্ষা উসকে দিতে পারে গোঁড়া ‘স্বদেশবাদি, চরম-জাতিয়তাবাদি মনোভাব যা থেকে জন্ম নিয়েছে ইসলামি মৌলবাদ, আরববাদ ইত্যাদি মতবাদ ও আন্দোলন’ (সাঈদ ১৯৯৪; ২৫৮)।
সাঈদের মতো আবদুল আর জানমোহামেদও উপনিবেশি জ্ঞানভাষ্য পুনর্লিখনের ওপর গুরুত্ব দেন। জানমোহামেদ মনে করেন স্থানিয়দেরকে ‘আন’রূপে দাঁড় করানোর ও নিয়ন্ত্রণ করার উত্তম জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সাহিত্য। স্থানিয়দের সংস্কৃতি মুছে উপনিবেশকের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এ-ক্ষেত্রটি খুবই কার্যকর। জানমোহামেদ এইসব সাহিত্যিক রচনা পুনর্লিখনের মধ্য দিয়ে উপনিবেশি জ্ঞানভাষ্যের (ইউরোপিয়/আন, আমরা/ওরা, সভ্য/স্থানিয় ইত্যাদির) দ্বিমেরু বিন্যাসটি উল্টে দিতে চান (জানমোহামেদ ১৯৯৯; ৫৯-৮৭)।
আসলে বি-উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক প্রশ্ন হল প্রাক-ঔপনিবেশিক অতীতকে কোন দৃষ্টিতে দেখছি আমরা, কোন মূল্য ধার্য করছি। প্রথমত, উপনিবেশে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক আধিপত্য শেষ হওয়ার পর আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উপনিবেশি বিন্যাসের শাসনপ্রক্রিয়ার ওপর সওয়ার হয়ে অগ্রসর হতে পারি। অনেক উপনিবেশে ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছে। এতে জনগণের বিরাট এক অংশ যেমন তখনো অবদমিত থেকে যায়, তেমনি উপনিবেশি সংস্কৃতির উপাদানগুলোও পুরো জোর নিয়ে বহাল থাকে। উপনিবেশবিরোধি জাতিয়তাবাদি আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-অর্জনের প্রক্রিয়ায় স্থানিয়দের এক অংশে বুর্জোয়া চরিত্র্যের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ফানোন আমাদের দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, এই জাতিয়-বুর্জোয়াদের ওপর সওয়ার হয়ে বহাল থেকে যায় উপনিবেশি বিন্যাস ও আধিপত্য। ফানোন বলেন:
স্বাধীনতার পূর্বে নেতারা মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা, রাজনৈতিক মুক্তি ও জাতিয় মর্যাদার কথা তুলে ধরেন। কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণার পর পর সাধারণ মানুষের প্রয়োজন-রুটি, জমি ও দেশকে জনতার পবিত্র পাতে তুলে দেওয়ার পরিবর্তে নেতারা প্রকাশ করে তাদের ভেতরের উদ্দেশ্য, এই লাভজনক কোম্পানিটির (অর্থাৎ দেশটির) জেনারেল প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তাদের অদৈম্য আগ্রহ: এটি চিত্রিত করে জাতিয় বুর্জোয়া চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। (ফানোন ১৯৬৮;১৬৬)

কার্যকর বি-উপনিবেশায়নের প্রসঙ্গে এসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।

এমনও দেখা যায়, উত্তর-উপনিবেশি সমাজের জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ উপনিবেশি শাসনকালে এবং স্বাধীনতার পর উপনিবেশি প্রভাব-বলয়ে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সাদামাটা প্রক্রিয়ার মধ্যেও প্রাক-ঔপনিবেশিক ভাবজগৎ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে চলেছে। জীবনচর্চার এই দিকগুলোও সনাক্ত করতে হবে। এগুলোকে ঐতিহ্যের মূল্যে ও মর্যাদায় দাঁড় করানো দরকার। কারণ উপনিবেশের শুরু থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে লড়াইয়ের যে-চেষ্টা হয়েছে তার নানা রূপ ও উপায় এবং মোট ফলাফলও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের ভাবজগৎ ও সংস্কৃতির মধ্যে এ-ধরনের অনেক প্রাক-ঔপনিবেশিক উপাদান চলমান আছে। গত কয়েক দশক ধরে ভারচুয়াল টেকনোলজির আগ্রাসি প্রসারের কারণে সেগুলো লোপ পেতে বসেছে। আবার তথাকথিত মার্গিয়-সংস্কৃতিতে অনুরক্ত লোকেরা-যাদেরকে ফানোন বলেছেন উপনিবেশক শোষকের বিকল্প, তারা প্রাক-ঔপনিবেশিক এইসব উপাদানকে প্রায়-নিকৃষ্ট ‘আনে’র অবস্থানে স্থাপন করে ওগুলোর নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে ওই জায়গাটা লড়াইয়ের একটা জরুরি ও বিস্তৃত ক্ষেত্র।
বি-উপনিবেশায়নের বিভিন্ন কৌশলের দু-একটি সাহিত্যিক দৃষ্টান্তও দিয়েছেন সাঈদ তাঁর কালচার অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম গ্রন্থে (সাঈদ ১৯৯৪; ২৫৪-৫৫)। জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেসে অভিব্যক্ত উপনিবেশি মনকে বিশ্লেষণ করেন তিনি, যার কেন্দ্র জুড়ে আছে উপনিবেশ-প্রতিষ্ঠা ও সেই উপনিবেশকে নিকৃষ্ট চিত্রিত করার রোখ। সাঈদ দেখান, এই পরিস্থিতি উলটে যেতে পারে উত্তর-উপনিবেশি বয়ানে। যেমন দেখা যায় কেনিয় লেখক নাগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর দি রিভার বিটুইন (১৯৬৫) এবং আরব লেখক তাইয়্যেব সালিহর সিজন অব মাইগ্রেশন টু দি নর্থে (১৯৭০)। নাগুগি হার্ট অব ডার্কনেসের মরা নিকৃষ্ট নদীটার একটা নাম দেন, তাতে প্রাণসঞ্চার করেন আর মিলিয়ে দেন স্থানিয় জনজীবনের সঙ্গে। এভাবে উপনিবেশকের বয়ানে স্থানিয় যে-নদীটি মরা, বিবর্ণ, বৈশিষ্ট্যহীন, নাগুগির লেখায় তা হয়ে ওঠে জীবন ও প্রাণময়তার প্রতিক। সালিহ্ ঔপনিবেশিক অভিযানের গতিমুখ উলটে দেন। তিনি দেখান, তাঁর প্রধানতম চরিত্র মোস্তফা সুদানের পাড়াগাঁ থেকে নীল নদ ধরে উত্তরে ইউরোপের কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হয়েছে এবং সেখানে সে নিজের ওপর এবং ইউরোপিয় নারীদের ওপর একরকম আচারমূলক সন্ত্রাস চালাচ্ছে। মানসিক আধিপত্যের উৎস ও আরোপনের মুখ এখানে উলটে গেছে।
নাগুগি ও সালিহর রচনায় প্রতিরোধের সংস্কৃতিকে প্রশংসার চোখে দেখেন সাঈদ। তিনি মূলত উপনিবেশি রচনার পুনঃপাঠ ও পুনর্লিখনের ওপর জোর দেন; তেমনি সা¤প্রতিক সাহিত্যে প্রতিরোধের মনোভঙ্গি সোচ্চার করার ব্যাপারেও আগ্রহি।
বি-উপনিবেশায়নের ক্ষেত্রে ভাষার প্রশ্নটি গুরুত্ববহ। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে উপনিবেশকের ভাষার জবরদস্তির মুখে স্থানিয় ভাষা প্রায় হারিয়ে গেছে। উপনিবেশের কারণে যাঁরা তাঁদের ভাষা হারিয়েছেন তাঁদের মনে পূর্ব-পুরুষের মুখের ভাষার প্রতি অফুরান দরদ থাকাই স্বাভাবিক। যেমন নাগুগি ওয়া থিয়োঙ্গা উপনিবেশকের ভাষা বর্জন করতে চান। তিনি মনে করেন, কোনো জনগোষ্ঠির প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে, এমনকি সমগ্র বিশ্বজগতের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তার নিজস্বতা বা আত্ম-পরিচয় কি, সে ধারণার মূলে থাকে ভাষার ব্যবহার ও ভাষা-নির্বাচনের বিষয়টি। এ-কারণে বিশ শতকের আফ্রিকায় প্রতিদ্ব›িদ্ব দুই সামাজিক শক্তির মূলে ছিল ভাষার প্রসঙ্গ। (নাগুগি ১৯৮৬, ৪)
আফ্রিকায় যাঁরা প্রচলিত উপনিবেশি ভাষাব্যবহারের পক্ষপাতি তাঁদের মধ্যে নয়া-উপনিবেশের প্রতি সমর্থনও লক্ষ করেন নাগুগি। আর যাঁরা নয়া-উপনিবেশায়নের বিরুদ্ধে লড়ছেন তাঁদের মধ্যে প্রবল পক্ষপাতিত্ব রয়েছে স্থানিয় ভাষার প্রতি। তিনি নিজে শ্রমজীবী কেনিয়দের ভাষা কিকুইয়ুতে সাহিত্যচর্চার পক্ষে কথা বলেছেন। এ-ভাষায় সাধারণ মানুষের অন্তর স্পর্শ করা সম্ভব।
উত্তর-উপনিবেশবাদে উপনিবেশিত জনগোষ্ঠির নিজস্বতার কথা যে বলা হচ্ছে, তার মধ্যে সাব-অলটার্ন বা নিম্নবর্গের প্রসঙ্গ এমনিতেই এসে পড়ে। বরং ফানোনকে মেনে আমরা যদি ধরে নিই, ক্ষমতার ধারক আধা-বিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি শেষ পর্যন্ত অনেকাংশে উপনিবেশক প্রশাসকদের বিকল্প, তাহলে প্রাক-ঔপনিবেশিক চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির জন্য আমাদেরকে সাব-অলটার্নদের খোঁজ করতে হবে। এদেশে সাব-অলটার্ন স্টাডিজ সম্পর্কিত কথাবার্তার সঙ্গে গায়ত্রি চক্রবর্তীর নাম জড়িয়ে আছে। সাব-অলটার্ন স্টাডিজ গ্রন্থমালার একজন সম্পাদকও তিনি। এসব কারণে ধরে নেওয়া হয় তিনি সাব-অলটার্ন বা নিম্নবর্গের ইতিহাস উদ্ধারের প্রতি নিবেদিত। কিন্তু গায়ত্রি মনে করেন সত্যিকার সাব-অলটার্নের নিজস্ব কণ্ঠ সনাক্ত করা অসম্ভব, সে কথা বলতে জানে না।
গায়ত্রি আসলে প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটা আবার তুলেছেন, সাঈদ যা আলোচনা করেছেন অরিয়েন্টালিজমে। আমরা যারা নিম্নবর্গের ইতিহাস লিখছি তারাও তো পশ্চিমের শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চমার্গের বুদ্ধিজীবী। তাহলে আমরাই-বা কি করে নিম্নবর্গের মানুষ সম্পর্কে ‘সত্য’ উচ্চারণ করতে সমর্থ? সেই ‘সত্য’ আসলে কতটা ‘সত্য’?
এ-প্রসঙ্গে আমরা গৌতম ভদ্রের ইমান ও নিশান গ্রন্থের নাম করতে পারি। ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে টিপু শাহ’র ইংরেজবিরোধি বিদ্রোহের ইতিহাস পুনর্গঠনে বিদ্রোহি জনগোষ্ঠির নিজস্ব বয়ান ব্যবহার করেছেন লেখক। বিদ্রোহিদের এই বয়ান ঔপনিবেশিক রেকর্ডকিপার, ইতিহাস-লেখক ও উপনিবেশক শাসকবর্গের এদেশিয় দোসরদের রচনার আড়ালে চাপা পড়ে ছিল দীর্ঘদিন। (ভদ্র. ১৯৯৪; ৬৮-৬৯)।
আমাদের ঐতিহ্যে আঠার শতকের শেষ ও ঊনিশ শতকের সূচনায় লিখিত বহু পুঁথিতেও নিম্নবর্গের কণ্ঠস্বর সনাক্ত করা সম্ভব। এছাড়া আছে লোকসাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডার। লোকসাহিত্যে নিম্নবর্গের প্রতিনিধিত্ব নানা কারণে প্রবল। এ সাহিত্য বিকশিত ও লালিত হয়েছে নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে। ওই কালে দরবারি/নাগরিক সংস্কৃতি ছিল ভৌগোলিকভাবে সীমাবদ্ধ, রক্ষণশিল ও ব্যয়বহুল। নাগরিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিম্নবর্গের মানুষের পরিচয় প্রায় ঘটেনি বললেই চলে। তাই নিম্নবর্গের কণ্ঠ-উদ্ধারে মৌখিক সাহিত্য সমৃদ্ধ জায়গা। এমনকি কোনো একটি জনগোষ্ঠির মৌখিক সাহিত্য থেকে তাদের প্রাক-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির মূল কাঠামোর অনেকখানি উদ্ধার করা সম্ভব। (দ্র. ফয়েজ আলম, ২০০৪)।
ভাবা ও গায়ত্রির অনুরূপ ঘটনার যেসব তাত্তি¡ক কেবল টেক্সটের মধ্যে উপনিবেশিতের অবস্থান বিচার করেন, তাদের সমালোচনা করেছেন অনেকে। এ-বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন জেনিটা পারি তাঁর প্রবলেমস ইন কারেন্ট থিয়োরিজ অব কলোনিয়াল ডিসকোর্স গ্রন্থে। ভাবা গায়ত্রির মতামত বিশ্লেষণ করে ফানোনের এই কথা মনে করিয়ে দেন পারি যে, ফানোনও সেইসব স্থানিয় লেখক ও বুদ্ধিজীবীর সীমাবদ্ধতা সনাক্ত করতে পেরেছিলেন, যারা (ফানোনের ভাষায়) ‘তাদের দেশের বহিরাগতদের কৌশল ও ভাষা ধার করে ব্যবহার করে’। (পারি, ১৯৯৪, ৪৩) পারির অভিযোগের তীর্যমুখ যে গায়ত্রি, ভাবা ও সমজাতিয়দের দিকে সন্দেহ নেই।
আরেকটা বিষয় আলোচিত হওয়া উচিত। অনেক সমাজের প্রাক-ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যে নারীকে দমন করার অভিজ্ঞতা আছে। বি-উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় ওইসব প্রবণতাকে কিভাবে গ্রহণ করা হবে তার একটা হেস্তনেস্ত আগেই হওয়া দরকার। প্রাক-ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন প্রসঙ্গে নারীর অবস্থানের দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সংস্কৃতির এমন কোনো উপাদান হুবহু পুনঃস্থাপিত করা ঠিক হবে না, যা উপনিবেশি প্রভাব নিষ্ক্রিয় করলেও নারীকে আবার ব্যক্তিগত উপনিবেশ হিসেবে দেখতে উৎসাহি হবে।
বি-উপনিবেশায়ন একটি জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এজন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি ও তৎপরতা দরকার; আবার, ত্বরিত ফলাফল আশা করাও অর্থহীন। উপনিবেশকের সংস্কৃতি বহু যুগ ধরে এখানে কাজ করেছে, প্রভাব বিস্তর করে গেছে। কয়েকটি বই লিখে আর আলোচনা সভা করে রাতারাতি সে-প্রভাব দূর করার ইচ্ছা একরকম কল্পজাগতিক ব্যাপার বলেই বোধ হবে। বি-উপনিবেশায়নের জন্য প্রথমে প্রয়োজন একটি তাত্তি¡ক ভিত্তি। বইপত্র আর সভা সমিতির প্রয়োজন সেই তাত্তি¡ক ভিত্তিটা স্থাপনের জন্য। তা প্রাথমিক কাজ মাত্র। মূল উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক তৎপরতা। সে-তৎপরতা সূচিত হবে নানা দিক থেকে; প্রবন্ধে-নিবন্ধে, সৃষ্টিশিল রচনায়, সাহিত্য-সমালোচনায়, নাটক, সংগীত, চিত্রশিল্প, সিনেমা, সাংবাদিকতা, এমনকি প্রকাশভঙ্গিতেও। উদ্যোগ নিতে হবে সম্মিলিতভাবে।

৩.
এতক্ষণ উত্তর-উপনিবেশি মনোভাব, তৎপরতা এবং কাজের ক্ষেত্র ও কৌশলগুলো নিয়ে যে আলোচনা হল তার লক্ষ্য মূলত আমাদের চৈতন্যে বহমান উপনিবেশি প্রভাব দূর করা। আগেও উলে­খ করা হয়েছে এই উপনিবেশি প্রভাবই পশ্চিমের দীর্ঘকালিন সাংস্কৃতিক আধিপত্য সম্ভব করে তুলেছে। উপনিবেশি জ্ঞানচর্চা ও সংস্কৃতি যে ‘আদর্শ মানুষ’-এর ধারণা প্রচার করেছে তা ইউরোপ-আমেরিকার সাদা মানুষের আদলে নির্মিত। আদর্শ মানুষের ধারণা আমাদের চৈতন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা মানবিয় স্বভাবের তুলনা করি ‘আদর্শ মানুষ’কে নমুনা ধরে, যার অর্থ দাঁড়ায় তুলনার মানদণ্ড হচ্ছে আদর্শ মানুষ (অর্থাৎ সাদা মানুষ)। এই সূত্রে (ইউরোপ-আমেরিকার সাদা) আদর্শ মানুষের যাবতিয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আমাদের সাংস্কৃতিক তৎপরতারও মানদণ্ড হয়ে ওঠে। অথচ আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মানদণ্ড হওয়া উচিত আমাদেরই অতীত অভিজ্ঞতা ও সুকৃতি। এটিই সাংস্কৃতিক আধিপত্যের গোড়ার কথা। পশ্চিমের সিনেমা, নাটক, উপন্যাস বা গানে আদর্শ মানুষের যেসব মূল্যবোধ, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, প্রবণতা উপস্থাপিত হয়, তা হয়ে ওঠে আমাদের সংশ্লিষ্ট শিল্পকর্মটির আদর্শ। জানা কথা, এই অনুকরণের খেলায় অনুকরণকারিই বরাবর হারবে, এবং একপর্যায়ে ভোক্তা মুখ ঘুরিয়ে মূল কাজটির দিকেই আগ্রহি হয়ে উঠবে। এ জটিল প্রক্রিয়াটি ভেঙে দেয়ার জন্য দরকার চৈতন্যে উপনিবেশি আদর্শগুলোর বিচ্যুতি এবং সেখানে উপনিবেশ-পূর্ব আদর্শের বাছাই অংশটুকুর প্রতিষ্ঠা, যা মূলত উত্তর-উপনিবেশবাদের লক্ষ্য। পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আধিপত্য এই মুহূর্তে চরম এক অবস্থায় পৌঁছেছে। দু’পাশের দোকান-পাট, অফিস তাকিয়ে দেখুন-বাংলা নাম খুঁজে পেতে কষ্ট হবে। খাবার দোকানগুলো ইংরেজি, ইতালি, ফরাসি বা আমেরিকান নামে ভর্তি। আবহাওয়ার সম্পূর্ণ বিপরিত ধরনের কাপড় চোপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। নামকরা গায়করা কাঠফাটা রোদের বৈশাখ মাসে টিভি অনুষ্ঠানে হাজির হচ্ছে সোয়েটার পরে, ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে। ফ্যাশনদুরস্ত হওয়ার আশাতেই ঐরকম উদ্ভট পোশাকের ছড়াছড়ি। আমাদের প্রচারমাধ্যম পশ্চিমের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি সংবাদ, ধারণা প্রতিরূপ প্রচার করছে দিনের পর দিন। এসবই দাস-চৈতন্যের অনিবার্য পরিণাম। শহুরে এলাকা পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বাজার। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানবিয় চৈতন্য থেকে শুরু করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতার ক্ষেত্রেও সচেতনভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। যে সব মাধ্যম সহজেই জনগণের মূল্যবোধ ও রুচির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে সেগুলোয় কাজ করতে হবে প্রথমে। যেমন সৃজনশিল সাহিত্য, নাটক-থিয়েটার, সিনেমা, টিভি প্রোগ্রাম, গান-বাজনা, চিত্রকলা, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান।
দরকার একটি তাত্তি¡ক প্রণোদনা, উত্তর-উপনিবেশবাদ যার যোগান দেয়। অতঃপর ঐতিহ্য-ইতিহাসের ভিত্তিতে আত্ম-পরিচয় পুনর্গঠন ও তার সাথে একাত্ম হওয়া দরকার। এরপরই আসে সেইসব মাধ্যমে কাজ যেগুলো গণ-পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম।
এ হচ্ছে লড়াই, সরাসরি ও দীর্ঘমেয়াদি। পৃথিবীতে এখন একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকা। আমেরিকা তার রুচি, ইচ্ছা, মূল্যবোধ, আকাক্সক্ষা চাপিয়ে দিচ্ছে গোটা পৃথিবীর ওপর। কারণ ওরা নিজেকেই মানবতার আদর্শ মানে। কিয়ার্নান যেমন চমৎকারভাবে বলেছেন, আমেরিকা ভাবতে ভালবাসে যে, সে যা চায়, গোটা মানবজাতি তাই চায়। (কিয়ার্নান, ১৯৭৮, ১২৭)। আমাদেরকে এখনই ঠিক করতে হবে আমরা কি পশ্চিমা আকাক্সক্ষার প্রতিমূর্তি হয়ে নয়া-উপনিবেশি দাসে পরিণত হব, না-কি নিজেদের মতো করে বাঁচব। যদি নিজেদের মতো বাঁচতে চাই তাহলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি আমাদের সাংস্কৃতিক ময়দানেও শুরু করতে হবে লড়াই এবং এই মুহূর্ত থেকেই।

গ্রন্থপঞ্জি

Ashcroft, Bill, Griffiths, Garreth. Helen, Tiffin (ed.). The Post-colonial Studies Reader, Routledge, London & New York. 1999.
Bhaba. Homi K., The Location of Culture, Routledge, London. 1994.
Fannon, Frantz, The Wretched of the Earth, Trans. Constance Farrington. Grove Widenfeld, New York, 1968.
JanMohamed. Abdul R., ‘The Economy of Manichean Allegory : The Function of Racial Difference’ in Ashcroft. Bill. et al.
Gramsci. Antonio : Selection from the Prison Notebooks. London. Lawenced & Wishart. 1998 Ngugi, Wa Thiongo, Decolonising the Mind : the Politics of Language in African Literature. James Currey, London, 1986.
Ngugi, James (Wa Thiongo), The River Between, Heineman, London 1965.
Parry. Benita, ‘Problems in Current Theories of Post-colonial Discourse’ in Ashcroft, Bill, et al.
Said Edward W., Culture and Imperialism, Vintage, London, 1994.
Said, Edward W., Orientalism, Penguin Books, London, 1995.
Salih. Yayeb, Season of Migration to the North, Trans. Denys Johnson Davies, Heineman, London. 1970.
Spivak, Gayatri Chakravorty, ‘Can the Subaltern Speak? in Ashcroft, Bill, et al.
Spivak, Gayatri Chakravorty, In Other Worlds : Essays in Cultrual Politics. Routledge, New York. 1988.
V.G. Kiernan: America : The New Imperalism: From White Settlement to world Hegemony, London, Zedbook, 1978.
Williams, Raymond, Problems in Materialism and Culture, Verso. London. 1982.
ফয়েজ আলম, প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি, র‌্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০০৪।
ফয়েজ আলম, উত্তর-উপনিবেশি মন, সংবেদ, ঢাকা, ২০০৬।

 

বর্ষ ৬, সংখ্যা ১০, ফেব্র“য়ারি ২০০৭

শেয়ার করুন: