সাহিত্যের আড্ডার প্রসঙ্গ যখন উঠলো, প্রথমেই মনে পড়ছে ভলতেয়ার লিখিত বিখ্যাত ‘কাদিদ’ এর কথা। দার্শনিক নানা ক‚টতর্কে ত্যক্ত-বিরক্ত কাদিদের শেষ উপলব্ধি ‘আসো কাজ করি’ সম্ভবত এটাই বইটির মূল উপদেশ। প্রায়শই সাহিত্যের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যবাদিতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, কিন্তু এই একটি মাত্র বই পাঠে প্রমাণ চলে সচেতন উদ্দেশ্যবাদিতাও শেষতক শিল্পে উত্তীর্ণ হতে পারে লেখকের অসাধারণ মুন্সিয়ানায়। অন্যদিকে সিদ্ধার্থ। ভারতের অন্তরজগৎ, বৌদ্ধধর্মের বিকাশ এবং স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ অথবা তাঁর প্যারালাল উপস্থাপন গৌতম বুদ্ধেরই মানস প্রতিরূপ সিদ্ধার্থ, নদির প্রবাহমানতা, জীবনের অন্তিম উপলব্ধি। দুটি বইই চিন্তা আশ্রিত। ‘তারাস বুলবা’ জাতিয়তাবাদি লেখক গোগলের জাতিপ্রীতির অসাধারণ দলিল। তুচ্ছ চুরুটের পাইপও শত্র“র হাতে ফেলে রেখে যেতে নারাজ তারাস বুলবা শত্র“র হাতে ধৃত হয়ে যখন সেনাদের উদ্দেশ্যে বলেন আবার বসন্তে এসো বন্ধুরা, তখন আমাদের চোখ অশ্র“সিক্ত হয়ে ওঠে। শেষের কবিতার অমিত-লাবণ্য, আটপৌঢ়ে গল্প নিয়ে ‘কবি’ জীবন এতো ছোট কেনে, পুতুল নাচের ইতিকথা’র ডা. শশি বা কুসুম, পথের পাঁচালির অপু বা দুর্গাকে বড় আপনার মনে হয়, ভাবতে ভাল লাগে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘কল্লোল যুগ’ দে গুরুর গা ধুইয়ে নজরুলের উদাত্ত আহবান কানে বাজে এখনো। হাড্ডি খিজিরের কথা মনে আছে আপনার? ইলিয়াসের অসাধারণ সৃষ্টি ‘মিলির হাতে স্টেনগান’ কিংবা ‘খোয়াবনামা’, শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘রক্তগোলাপ’, কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলি যাত্রা’। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরি, আবুল হাসানের গিতল কবিতা থেকে একেবারে সাম্প্রতিক তরুণ কবি-লেখকও কি বাদ পড়েন সাহিত্য ক্লাব আয়োজিত পাঠচক্রে। অসংখ্য বইয়ের সাথে পরিচয়, যার বেশির ভাগই হয়তো কখনো পড়া হয়ে উঠত না এই পাঠচক্রে না আসলে। শুধুই বই পড়া-আত্মজিজ্ঞাসার উদয় হয় না মনে একবারও? এক একটা বই নতুন অচেনা জগতের উন্মোচন। যে জগত ছুতে পারবো না, যে জগতের মানুষ চির অচেনা অধরা সেই মানুষগুলো বইয়ের বদৌলতে আপনার হয়। তো, হতে পারে নিছক আনন্দের জন্যও পাঠ, হতে পারে বহিঃপৃথিবী জানার আকাক্সক্ষা, মানুষের মনোজগতে প্রবেশের দুর্লভ সুযোগ। আলোচনা-সমালোচনার জন্যও পাঠ হয়।
বাঙলা সমালোচনা-সাহিত্যের মান কেমন কথাটা এভাবে না বলে যদি একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে সমালোচনা-সাহিত্যকে বিবেচনা করা হয়।-আদৌ এখানে সমালোচনা-সাহিত্য গড়ে উঠেছে কি? তুলনামূলক ভাষাতত্ত¡ বলে যা প্রচারিত সেখানে আমাদের বিবেচনাশক্তি কোন পর্যায়ের? সাহিত্য পাঠের মানদণ্ড কি? কোন মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে সাহিত্য শিল্পে কালোত্তীর্ণ বলা যাবে? শিল্প বলবো কোনটিকে, কোনটিকে বলবো না? না বলার কারণ কি? সাহিত্য কি শুধু আনন্দ বর্ধনের জন্যই?-সাহিত্যের সুনির্দিষ্ট লক্ষ, আদর্শ, উদ্দেশ্য কি? সুনির্দিষ্ট লক্ষ, আদর্শ, উদ্দেশ্য থাকা কতটা প্রয়োজনিয়? এরিস্টটল তাঁর সৌন্দর্যতত্তে¡ বিষয়গুলো খোলাসা করার চেষ্টা করেছেন, কতটা সফল হয়েছেন সেটা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ। নান্দনিক সৌন্দর্যবোধ সকলের এক না, ব্যক্তিভেদে চেতনার হেরফের হয়। সাহিত্য শিল্পের আপাত নৈর্ব্যক্তিক জায়গায় একমত হওয়া সম্ভবও নয়। সাহিত্যে রাজনীতি, উদ্দেশ্যবাদি নৈতিকতা, সচেতন ম্যানুফেস্টোর অনুপ্রবেশ কতটা জরুরি? থাকতেই হবে কি? এসব প্রশ্ন নিছক প্রশ্ন নয়, সাহিত্য ক্লাবের প্রতিটি পাঠ-পর্যালোচনা অন্তে এসব বিষয় নিয়ে কথা ওঠে। সমাধানের চেষ্টা যুক্তি উপস্থাপন করেন কেউ কেউ। উত্তর প্রায়শই উহ্য থাকে, কিন্তু মনের গভীরে যে আলোড়ন তার রেশ চলতে থাকে, কখনো কখনো বর্ধিত হয় মাত্র।
বিশ্বায়নের কারণে শহর ও গ্রামের সংস্কৃতি ও সমাজজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। রাজনীতি, নয়া-ঔপনিবেশিক স্রোত, মুক্তবাজার, বহুজাতিক আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদি সবক মানুষকে দিশেহারা করছে। আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রথাগত মানে যাচ্ছে বদলে। কৌশলে বিলুপ্ত করে দেয়া হচ্ছে ব্যক্তিসত্তাকে। ব্যক্তিকে করে ফেলা হচ্ছে একক, স্থবির, পঙ্গু। বিপ্লব বা চিন্তার সম্ভাবনা নষ্ট করতে চলে নানা আয়োজন। বিশ্বায়নে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ভাষার উপরও একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয়। অন্তর্জাল ছড়িয়ে দেয়া হয় এমনভাবে ভোক্তা অনেক সময়ই জানে না কি সে নিচ্ছে, গ্রহণ করছে। ভোগের উপকরণ বেড়েছে। কৌশলে মানুষকে ভোগবাদি করে ফেলা হচ্ছে। অস্থিরতা বাড়ছে। পণ্যদুনিয়া কনজিউমারিজম কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে মানুষকে? ডিজিটাল ইকোনমি যে ইনফরমেশন সোসাইটি তৈরি করছে সেখানে ব্যক্তির সামাজিক পরিচয় ক্রমশ অদৃশ্য। গড়ে উঠছে ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিক পরিচয়। সমাজে মেলামেশার সুযোগ কমে যাচ্ছে, দূরত্ব বাড়ছে প্রতিনিয়ত মানুষে মানুষে। চলমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সাহিত্য মানুষের মনোজগতের একাকিত্ব, স্বপ্নজগত নির্মাণে সহায়ক। কল্পনার সাথে বাস্তবতার যে ফারাক রুঢ়তা তা বোধে চমৎকারভাবে প্রতিস্থাপিত হয় সাহিত্য-শিল্পের মাধ্যমে। লেখক তাড়নার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন লেখায়, সেটাই পাঠক পুনপাঠে আবিষ্কার করে পাঠের মাধ্যমে। সপ্তাহের একটা সময় আবছা ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাওয়া, দুঃসাহসের ডানায় উড়তে পারা; মানুষতো নিজেও চির একাকি, অসহায়, যন্ত্রসভ্যতার বলি, সে সময় একটা বই-যদি সেটা হয় শিল্পমানে উত্তীর্ণ, চরিত্রের ঠাঁস বুনন বিষয়ের ভেতর তলিয়ে যেতে সাহায্য করে। অনেক পাঠক একসাথে একই বই নিয়ে আলোচনা-পাঠের আনন্দ বাড়িয়ে দেয় নিঃসন্দেহে হাজার গুণ। যে বিষয়টি বিবেচনায় ছিল না, ভাবিনি এভাবে, অন্যের পঠনব্যাখ্যা আপ্লুত করলো, ভাবতে সাহায্য করলো নতুন করে। স্বীকার করি, পণ্যায়ন ও মুক্ত বাজার অর্থনীতি, এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা তথা বিশ্বায়নের যুগে সাহিত্য ও সাহিত্যরুচি এবং জন-আকাক্সক্ষা বদলে যাচ্ছে আশ্চর্যভাবে। মিডিয়ার তেলেসমাতি, পণ্যবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, ঔদ্ধত্য, চাপিয়ে দেবার প্রবণতা অনেক সময়ই শিল্প মানে উত্তীর্ণ নয়, এমন বস্তুও গছিয়ে দেয়, দেয়ার চেষ্টা করে। বারংবার বিজ্ঞাপন-প্রচারণা মাজেজায় পাঠক পড়তে প্রলুব্ধও হয় খানিকটা।
তো, সাহিত্য আড্ডার এই নানা আটপৌঢ়ে বিষয়াবলির সাথে কখনো কখনো চিন্তামূলক আখ্যানও যুক্ত হয়। কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটকের সৃজনশিল বই পাঠের সাথে সাথে যুক্ত হন স্বামি বিবেকানন্দ (শিকাগো ভাষণ), বিদ্যাসাগর আর রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘চারিত্র্যপূজা’, উপনিষদের অংশবিশেষ। অনেকদিনব্যাপি মহাকাব্য রামায়ণ কিংবা মহাভারত পড়বার আনন্দইবা কম কী। ‘রুশ গল্প সংকলন’ দিয়ে যে ক্লাবের যাত্রা শুরু আজ এতগুলো বছর পরও সেটা চলছে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, বিশেষ করে মিডিয়া আগ্রাসনের এই যুগে। মানুষের নিরবচ্ছিন্ন অবসর যেমন কমে গেছে তেমনি জীবন-জীবিকার সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা উৎপাতে গলধঘর্ম প্রতিদিন। নগদপ্রাপ্তির লোভ তাড়িত জীবনে আপাত লাভহীন এধরনের ক্লাব পরিচালনা এবং তাতে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের বৈষয়িকচিন্তাবিহিন সাধনা নানা কারণেই চমৎকৃত করে। সিরিয়াস বইয়ের পাঠক কিংবা পঠনঅভ্যাস কমে যাচ্ছে এ ধরনের প্রচারণার বিপরিতে দাঁড়িয়ে সাহিত্য ক্লাব মৌলিক চিরায়ত ও সমকালিন বইয়ের সাথে পাঠককে যুক্ত করতে পারছে, ভিন্নচিন্তা উসকে দিচ্ছে, এটাই বড় পাওনা।