বেদনা-প্রধান আশা
ঘুমিয়ে পড়ার আগে মধ্যরাতে আমার পরিচিত মানুষদের মুখ ও কথোপকথন
খুব মনে পড়ে প্রতিদিন… সেখানে একজনও অচেনা মানুষ
থাকে না। আমি চোরকে চোর সাধুকে সাধু ভেবে
ঘুমানোর আগে তাদের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে
পাশের বাড়ি থেকে রবীন্দ্রসংগিত শোনা যায়-
বেদনা-প্রধান আশা নিয়ে গান গেয়ে যায় আমার প্রিয়
শিল্পি অর্ঘ সেন, সুবিনয় রায়।
মহিলাদের হাতে চলে গেছে-কেদারা বাণিজ্য!
প্রীতিলতা মরে গেছে; এখনই আমার চিন্তা-ফুল
ভোরের শিশিরের মাটিতে ঝরে পড়ে যাবে;
সকালে সূর্য ওঠার আগেই পথে এসে দাঁড়াবে
অচেনা ভিখারি! মানুষ ঘুমের ভেতর নিজের বুক চেপে
উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে; এসব দেখে যায় পাশের জন নিরবে
নিজের মতো; বিছানায় তখন নিজের কোনো ভূমিকা
থাকে না। জীবন মানে বেশি সময় নিজেকে ব্যর্থ মনে করা এবং
চমকপ্রদ কিছু খবর নিয়ে দেরিতে প্রিয়জনের সাথে দেখা করা।
আশ্চর্য শান্তিতে ঘুমাচ্ছে কতজন? আমরা জানি না।
ফুলিশ! কে আছে আমাদের পেছনে; যে যে পথ
হারিয়েছে-তাদের বাড়ি পৌঁছে দাও।
সোহাগি এখনো ঘুমায়নি।
পাখি ও মানুষ
পাখি বহু চেষ্টার পরও স্বপ্নে পাখা
মেলতে পারে না
কারণ পাখিরা উড়তে জানে
মানুষ স্বপ্নে উড়তে পারে
কারণ মানুষের ডানা নেই।
সুবর্ণনগর
আকাশের দিকে তাকালে মন ভালো হয়ে যায়
অন্য আকাশের কথা মনে পড়ে-যে আকাশের বুকে
নক্ষত্রেরা হাসে, আকাশের দিকে
তাকালে একটু সময় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়।
আমরা কি কোনোদিনই মাথা উঁচু করে
সুবর্ণনগরিতে প্রবেশ করতে পারবো না? আমাদের জন্ম-মৃত্যুর
পরেও থেকে যাবে শূন্য আকাশ! যে আকাশের দিকে
তাকালে আমাদের মন ভালো হয়ে যায়। নিঃসঙ্গ মানুষ
প্রশ্নচিহ্নের মতো একা দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়… আপনি
কোথায় যাবেন, মহাশয়?
কেউ জিজ্ঞেস করে না।
সূবর্ণনগর কতদূর!
আলোর নিচে মানুষ
আমার এই কাহিনি জীবন থেকে এসেছে জানি,
অবিরত দুঃখ পাই; বটের পাতার মতো ঝরে
যায় সময়, নদি জলে সাঁতার কাটে মানুষ
এসব দেখে পাখিরা আকাশে উড়ে যায় এখন!
আলোর নিচে মানুষ দেখছে অন্ধকার এসেছে
শরতের আলোয় অতসির মুখ দেখা যায়;
পূজার আবেগ নিয়ে পুরোহিত বসে থাকে একা
সাতরঙ রঙধনু আকাশে ওঠে বৃষ্টির গানে।
আমারও ব্যথা জাগে মনে পুরনো কথার টানে
কতদিন দেখি নাই তারে, সে থাকে এখন দূরে;
দুঃখ অবিরত জেনে স্মৃতির পুতুল নাচে মনে
বাসিও তারে ভালো এসব জানে আগেকার মতো-
চিরকাল থেকে যাবে আমারই বেদনার কথা
জীবনের কথা ভাবি আবার এখন সবিনয়ে…
২.
সাদাফুল পূর্ণিমায় ভোরবেলা নদিজলে ভেসে
যায় অবিরত মনে; শিউলিফুলের মুখ সন্ধ্যাবেলার আরতি
নিয়ে জেগে ওঠে প্রাণে, অনেক দিন পরে এসব-
ফুলের ঘ্রাণে মানুষ দেখে যায় এইসব আমাদের গান
অপেক্ষায় খুঁজি হাত সারারাত মৃত্যু হবে জেনে
জন্ম-মৃত্যুর খেলায় আমাকে বাঁচিয়ে রাখে আলো আশির্বাদ
পৃথিবীর শেষ গান পর্যন্ত দেখে যাও পূর্ণিমার আলো
এক রাতের শিউলিফুলের ঘ্রাণ আমার মতো দীর্ঘস্থায়ি
জীবন যেন তোমার ভালোবাসায় এসব নতুন দিনের গান
রচয়িতা এক কবি অনেক দিন পর এ আলো
দেখে নিয়ে তারপর হঠাৎ মুখ ম্লান করে থাকে
পাখির ঠোঁটে ফুলের পুনঃজন্ম অপেক্ষার খেলা
জীবনের গানে স্বপ্ন জাগে ভোর হবে তাই মেনে
আমিও যাই ফুলের কাছে ঘ্রাণ থেকে ঘ্রাণে রাতে
তোমার ভালোবাসায় আমার যেন মরণ হয়
[এখন রসুলপুরে ফিরেছি, আবার যাব তিনমাস পরে।]
৩.
আমার কবিতাই তো আমার গান গাইবো একা
মনে মনে বার বার প্রতিদিন আবার এসব
জেনেও তোমরা থাক আমার থেকে দূরে অদূরে…
সুখপাখিতো খাঁচায় বন্দি দেবে তারে মুক্ত করে
আমার বেদনার এ গান পাখি গায় নিরবে এখন
কত স্বপ্ন কত স্মৃতি নতুন করে জাগবে মনে
আমার উঠোনে এক কাঠবিড়ালি নেচে যায়
সকাল থেকে বিকাল সবাই দেখে আমিই শুধু
অবিরত দুঃখ পুষি নিজের মতো জীবনময় …
আমিও স্বপ্ন দেখি না কাঁঠাল পাতার রঙে আঁকি
তুমি থাক আর আমি থাকি দুজনেই যে পোষাপাখি…
৪.
কাণ্ডজ্ঞান:
পাথর পানিতে ডুবে যায়।
মানুষ:
জীবিত অবস্থায় পানিতে ডুবে যায়;
মৃত অবস্থায় ভেসে ওঠে।
অতএব পাথর জড় পদার্থ
মানুষ জীবসত্তা!
বিপরিত চিন্তা :
পাথর জড় পদার্থ, পাথরের প্রাণ নেই
তবে পাথর বড় হয় কেন?
মানুষও কখনো কখনো পাথর হয়ে যায়।
৫.
একজন অন্ধ মানুষ অন্যের হাত ধরার জন্য
পথে দাঁড়িয়ে থাকে, অনেক দূর যাবে বলে…
দমকল
কসমস-এ আগুন লেগেছে
পুড়ে ছাই হতে দেবে না দমকলবাহিনি
কসমস যে আমিরের বাগান
অন্ধকারে জ্বলে উঠছে রাত্রির ফুল-
অন্ধকার বা আলো যে কোনো অবস্থা থেকেই
শুরু করতে চাই আজ!
অনেকদিন অকারণেই বয়ে গেল নদির জল…
একথা ঠিক, আমাদের অনেক কিছুই নেই
একথাও ঠিক, যা যা ছিলো
তাও সব ধরে রাখতে পারিনি
যেমন: ক্ষমতা ও শৃঙ্খলতা
বাগানে আগুন লেগেছে, পুড়ে ছাই হতে দাও
দমকলবাহিনি।
কবিতাঙ্ক
সকালের সূর্য ওঠার আগেই যদি
খাঁচার পাখি উড়ে যায়-
ঐশ্বর্য নদির জল জীবনের সমান বয়সি
নিঃসঙ্গ চাঁদ অসম ভালোবাসার
বেদনায় জেগে থাকে।
গাছের আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শত্র“-
বাঘ হিংস্র একথা জানে বনের অন্য সব পশু;
তবুও একই বনে তাদের দেখা হয়।
সন্ন্যাসি পাথর ভেঙে শূন্যতার কাছে জল চায়!
কার ধর্মে কার পাপে কে কতটা হয়েছে স্থানচ্যুত?
মানুষের কাছে এখনও রয়েছে দূরবর্তি আশা;
আশ্রয়প্রার্থি রাতের অন্ধকারে আলো জ্বেলে দেখে
নিজের মুখ, কতটা সহনিয় ছিল ভালোবাসা।
শূন্যতার ভেতর মায়ার বদলে আমি জীবনের
আনন্দ খোঁজার পক্ষপাতি… জীবনের সঙ্গে
আমার কোনো বিরোধ নেই, নেই কি!
শূন্যতাই অস্থিরতা…
ভালোবাসা দেবার পর কেন
এত বিচলিত আমরা?
অনুরূপেষু সন্ধ্যা
অলস রাতে ঘুমিয়ে যায় শরীর-ছায়া
ঘুণপোকা চোখের পাতায় আশ্রয় নেয়
স্মৃতি গর্ভে বিদ্রƒপ মেশায় ফুলের মায়া
সন্ধ্যা আসে, সে বধূ সেজে অন্ধকারে যায়
যার তুলনায় নতুন সবই মুমূর্ষু…
নির্জন পালঙ্কে কাছাকাছি বসে দু’জনে
শূন্যতা ভাঙে, ভবিষ্যতের মুখোশ হাত
আকাশ ছুঁয়ে যায়, স্নেহের রাত্রিযাপনে
রঙিন চোখের হরফে নেচে ওঠে রাত
পাথরে মুখ দেখে মায়াবি অনুরূপেষু
নিঃসঙ্গ সন্ধ্যা, সুনিল কথার উৎসব:
পুরনো বাড়ির কঙ্কাল প্রাচিন মুদ্রায়
অলস ভঙিমায় কাঁদে অস্তিত্বের সব
চেনা দু’চোখ অবসরে এখনো তাকায়…
দু’হাত পেরেকে গেঁথে মৃত্যু দেখেছে যিশু!
বর্ণ-ছায়া
দেখা হবে কোনো একদিন অন্ধকার
হৃদয়ে বর্ণ-ছায়া, শরৎ-ঘ্রাণ শুষে
নেয় বিবর পুরুষ অন্তঃপুরে বসে
আজ তার কণ্ঠ যেন দস্যুর সেতার…
হরষিত ঘরবাড়ি সুনিল আকাশ
উঠোনের দূর্বাঘাসে শামুক ঘুমায়
স্তব্ধ কপাট এই হাতের মুঠোয়
রাতের ধূপ যেখানে ছড়ায় সুবাস
মুখশ্রি তার প্রাচিন এবং স্বপ্ন-রাঙা
লালিত নিমন্ত্রণে-যা, আমারই মতো
চোখের ঘুমে মেশে একা নির্জন রাতে-
ফুলের ভঙিমা, কপালের আলো-ছায়া
সাদা কাগজের মতো নিঃশব্দ হৃদয়
লজ্জা রাতের চিত্রকল্প সহজে ক্ষয়!