মূল: এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ
এটা শুধু একটা ‘ইস্যু’ নয়, বরং একজন মানুষ এবং একটা বই। মানুষ হিসেবে সালমান রুশদী যে-কারো সহনসীমার চেয়েও বেশি দুর্ভোগ সয়েছেন। চার বছর ধরে অজ্ঞাতবাসে হারিয়েছেন নিজস্ব জীবন, হারিয়েছেন সকল ব্যক্তিগত প্রশান্তি। অবিরাম স্থানবদলে পরিবার আর বন্ধুদের সাথে নিরুপায় যোগাযোগহীন, রয়েছেন আততায়ী-তাড়িত, আর তাও কিনা সারা পৃথিবীর চোখের সামনে দিয়েই, রয়েছে সেই ভয়ঙ্কর ইরানি ফতোয়া – তা প্রতিশোধপরায়ণতায় যেমন অনমনীয়, তেমনি হননপ্রয়াসে বোধহীন – অথচ এইসব কথা খবরে আসে খুব কমই, ক্বচিৎ-সংবাদের বিষয় হয় শুধু। কোনো অবস্থাতেই, যে-কাউকেই এমন জীবনে বাধ্য করা ঠিক নয় মোটেও।
কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত সে বইটাকেও – ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। চেনাজানা দুনিয়া থেকে স্থানান্তরণ, অসুস্থিতি আর অবিশ্বাস-সন্দেহের আবহে মোড়া এক মহাকাব্যিক সৃষ্টি এ রচনা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় পরিচয়ের প্রথানুগ সুনির্দিষ্টতার অনুকূল সমস্ত ধারনাকে, আর তা করে যথোপযুক্ত বুদ্ধির ঝলকে আর মৌলিকতায়। এর শক্তিকে মেনে নেয়াটা পাঠকদের কাছে কেন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়? কারণ এ লেখা শুধু ধর্মীয় গোঁড়ামিকেই উল্টেপাল্টে দেয় না, আঘাত করে জাতিগত আর সংস্কৃতির গোঁড়ামিকেও। দ্য স্যাটানিক ভার্সেস হলো উপন্যাস হিসেবে একটা বিরাট সৃষ্টি, এবং প্রতিষ্ঠিত প্রথা-অভ্যাসসমূহ, অলস কর্তৃত্বপক্ষ, আর অচিন্তাশীল নির্জ্ঞান সম্মতির ধারার বিরুদ্ধে এক চ্যালেঞ্জ। ইসলামের নামে ঘৃণ্য অপবাদের যে কথা বলা হচ্ছে, পাঠকরা চাইলে তা একপাশে সরিয়ে রেখে, সে দিকটাকে উপেক্ষা ক’রেও বইটাকে দেখতে পারেন। এর বর্ণনা আকর্ষণীয়, মনকাড়া, আর মজারও। কোনো হাসি-নিষিদ্ধ মুখগোমড়া জ্ঞানোপদেশ নেই এতে, আছে যেন এক স্ফূর্তিভরা রঙের মেলা। আর যে কোনো পাল্টা-মতবাদ বা নয়া কঠোরতাবাজির তুলনায় তা বরং অনেক মানবিক। তাই এর লেখক নিজেই এই বইতে স্বপ্রকাশ।
শেষ কথা হলো – সাবেক-উপনিবেশ দেশগুলোর, হোক ইসলামি বা আরব দেশগুলো বা তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন অংশের অন্যান্য বহু দেশ, ওই সব দেশের লেখক আর সাধারণ নারী-পুরুষদের জন্যও রুশদী একটা কারণ, একটা প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
ক্ষমতা-শক্তিমত্তার বিরুদ্ধে যারা কথা ব’লে উঠতে পারেন তাদের প্রতিজনই রুশদী। যারা বলতে পারেন, আমরা অধিকার রাখি ভাববার আর নিষিদ্ধ চিন্তা প্রকাশের, গণতন্ত্র আর মতধারণের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ়কণ্ঠ হবার। এখন সময় এসেছে পৃথিবীর এই অংশের আমাদের জন্যও, এই কথা বলবার যে, আমরা এই ফতোয়ার বিরোধী, এবং আমরা বিরোধী সমস্ত ফতোয়ার যেগুলো মানুষের বাক্হরণ করে, নির্যাতন করে, কারাবন্দী করে, ভয় দেখায়; আর নিষিদ্ধ করে, পুড়িয়ে ফেলে বা অভিসম্পাত দেয় বইয়ের মতো বস্তুকে। রুশদী, তার বই আর তার জীবন এসে দাঁড়িয়েছে সেই সীমান্তরেখায়, স্বয়ং ক্ষমতাদম্ভ যেখানে তার নিষ্ঠুর ফরমান উচ্চারণ আর সবলে প্রয়োগ করে। তার দিক থেকে বিষয়টা ইসলাম অবমাননার নয়, বরং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে এগিয়ে যাবার জন্য এক স্পর্শাঘাত, যে গণতন্ত্র থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত ক’রে রাখা হয়েছে, আর সে সংগ্রামে কখনো না থামবার সাহস ধ’রে রাখবার জন্যও। রুশদী হচ্ছেন কল্পনাশক্তি আর সৃজনশীলতার ইন্তিফাদা।
——————-
(ফিলিস্তিনে জন্ম নেয়া সাহিত্য-সংস্কৃতির তাত্ত্বিক, জনপক্ষের বুদ্ধিজীবী, আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক, উত্তর-উপনিবেশিক অধ্যয়নশাস্ত্রের প্রবর্তক এডওয়ার্ড ওয়াদি সাইদ (১৯৩৫–২০০৩) ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটাকে, এর লেখকের বিরুদ্ধে ফতোয়াকে, আর এ দু’য়ের প্রেক্ষিতে বইটার লেখক সালমান রুশদীকে যে চোখে দেখেছিলেন, তা-ই বর্ণিত হয়েছে এ লেখায়।)
ভাষান্তর: রাকি ইউসুফ